রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন শতবর্ষী বৃদ্ধা শ্যাম দাসী রায়। মাঝরাতে দরজায় টোকা পড়ে তার। দরজা খুলেই দেখতে পারেন স্থানীয় কয়েকজন বখাটেসহ উঠোনজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ। খুঁজতে এসেছে তার হাঁটতে অক্ষম পঙ্গু ছেলেকে। পুলিশের অভিযোগ, ‘এক ব্যক্তিকে হত্যাচেষ্টা চালিয়েছে তার ছেলে।’ এ কথা শুনে মুর্ছা যান ওই নারী। পুলিশের গ্রেফতারের ভয়ে আগে থেকেই বাড়ির বাইরে থাকতো তার ছেলে। ছেলেকে খুঁজে না পেয়ে বৃদ্ধা মা’কেই শাসিয়ে যায় পুলিশ। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তিনি।
শুধু শ্যাম দাসী রায় নয়, ঢাকার ধামরাইয়ের কুল্লা ইউনিয়নের মাখুলিয়া গ্রামে আকসির নগর নামে এক আবাসন প্রকল্পের দেয়া মামলায় গত ৩০ জুলাই মাঝরাতে এমন করে দরজায় ধাক্কা পড়েছে আরো অন্তত ২০টি পরিবারে। একারণে ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এসব বাড়ির পুরুষ সদস্যরা।
হত্যাচেষ্টা মামলার ৬ আসামী ধরতে গত শুক্রবার মধ্যরাতে গ্রাম জুড়ে ঘরে ঘরে তল্লাশি চালান ধামরাই থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুস সালাম। এতে পুরো গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২২ জুন নিজের জমিতে কাজ করছিলেন মামলার বাদী। পরে সেখানে গিয়ে বাঁধা দিয়ে মাখুলিয়া গ্রামের কয়েকজন ব্যক্তি। সেখানে বাদীকে মারধর করে আহত করা হয় বলেও জানানো হয়। পরে এ ঘটনায় গত ২৯ জুলাই ধামরাই থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করলে ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুস সালামকে। এর পরই আসামি ধরতে তল্লাশি শুরু করেন তিনি। এতেই এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক।
অভিযোগ রয়েছে, আকসির নগর কর্তৃপক্ষের জমি দখলের প্রতিবাদ করায় ঘুরেফিরে কিছুদিন পরপরই ওই ৬-৭ জনকে মামলার আসামী করা হয়।
জানা যায়, অভিযোগে উল্লেখিত প্রধান আসামী সাইদুর রহমান এলাকায় যান না প্রায় ১ বছর ধরে। এছাড়া আরেক আসামী ভঞ্জন রায় ওই আবাসন কর্তৃপক্ষের হামলায় পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। তিনি ঠিক মতো হাঁটতে পারেন না। এছাড়া অন্যান্যরাও কৃষি কাজ করে জীবন নির্বাহ করেন।
এলাকাবাসী জানায়, গতকাল রাতে আকসির নগর কর্তৃপক্ষের লোকজনসহ আসামীদের বাড়ি বাড়ি হানা দেয় পুলিশ। এসময় আসামীদের খুঁজতে তাদের প্রতিবেশীদের ঘরে ঢুকেও তল্লাশি চালায় পুলিশ। এ ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রামে। ভয়ে রাতেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান এলাকার বেশিরভাগ পুরুষ সদস্যরা।
শতবর্ষী শ্যাম দাসী রায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার স্বামীর রেখে যাওয়া জমি দখল চেষ্টা চালায় আকসির নগর। সেটার প্রতিবাদ করায় আমার ছেলেকে অফিসে নিয়ে মারধর করে পা ভেঙ্গে দেয়। পঙ্গু হাসপাতালে দুইমাস চিকিৎসা শেষে সে কয়েকদিন আগেই বাড়ি ফিরছে। এখনো হাঁটা চলা করতে পারে না। এরমধ্যেই আরেক মামলার আসামি হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী নাই। সংসার চালায় এই ছেলেটা। তাকেও নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। আমি নাতনিদের নিয়ে শুয়ে ছিলাম। মাঝরাতে হঠাৎ আমাদের ঘরের দরজা ধাক্কানো শুরু হয়। তারপর দেখি পুলিশ আসছে আকসির নগরের লোকজন নিয়ে। তারপর তারা আমার আরেক ছেলের বাড়িও হানা দেয়। পুলিশ আমাদের ভরসা না হয়ে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
একইভাবে মাঝরাতে দরজায় ধাক্কা পড়ে আকলিমা বেগম নামে আরেক নারীর দরজায়ও। মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। পুলিশের প্রতি ক্ষোভ জানিয়ে আকলিমা বেগম বলেন, ‘আকসির নগর আসছে অনেক দিন ধরে। তারা আমাদের ওপর অনেক জুলুম করছে। আমার ভাসুর এখানে থাকেন না। এলাকায় আসেন ও না। তবুও তাকে মামলার আসামী করা হয়েছে। পুলিশ ওই কোম্পানির গুন্ডাদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি যায়। তাদের ভয়ে পুরুষরা ঘরে থাকতে পারে না। পাড়ার মানুষ ঘুমাতে পারে না। পুলিশ জনগণের বন্ধু। আর তাদের আসার খবরে আমরা ভয় পাই এখন।’
দুপুরবেলা গরুর দুধ দোয়াচ্ছিলেন ভানু বিশ্বাস নামে আরেক নারী। ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাড়িতে আমি আর আমার ছেলের বউ ছিলাম। আমি গরুর দুইয়ে দিচ্ছিলাম। এরমধ্যে হুরমুর করে পুলিশ আসে। আমার বাড়ির কেউ আসামি না। আরেক আসামিকে ধরতে আমার বাড়িতে তারা হানা দেয়। আর আসার সময় আকসির নগরের লোকজনসহ আসে তারা। ভয় দেখায় নানা ভাবে।
মামলার বিষয়ে জানতে আকসির নগর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (অর্থ) আমিনুল ইসলাম সোহাগকে ফোন করা হলে তিনি বাসায় আছেন জানিয়ে বের হয়ে ফোন করবেন বলে জানান।
এদিকে এ ঘটনা জানতে মুঠোফোনে ধামরাই থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুস সালামকে কল দেয়া হলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে, ‘বিষয়টি দেখতেছি’ মন্তব্য করে ফোন কেটে দেন তিনি।
এ বিষয়ে ঢাকা জেলা পুলিশের সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) শাহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি বিষয়টি জানি না। তবে যদি এমন তথ্য থাকে যে আসামী লুকিয়ে রয়েছে তাহলে অবশ্যই তারা সেখানে যেতে পারে। আর এই বিষয়ে যদি কোন অভিযোগ থাকে তাহলে লিখিত অভিযোগ দিলে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুলিশের তদন্ত কাজে যদি কেউ ভুক্তভোগী হয়ে যায় সেটা অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। একইসঙ্গে যদি অভিযোগ মিথ্যা হয়, বা পত্রিকায়ও সঠিক রিপোর্ট না ছাপা হয় তাহলে আমরা আপনাদের অফিসেও জানাতে পারি।
এই বিভাগের আরও খবর....