ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে সালিশের রায়ে সংখ্যালঘু পরিবার ২৮ মাস যাবত ‘একঘরে’ হয়ে আছে। সামাজিক কোনো আচার অনুষ্ঠান কিংবা ধর্মীয় কাজে তাদের অংশগ্রহন করতে দেওয়া হচ্ছে না। এতে রাগে অভিমানে ওই পরিবারের লোকেরা ধর্ম ত্যাগের পাশাপাশি বিষপানে আত্মহূতির হুমকি দিয়েছেন।
উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ কাজল চৌধুরী প্রায় আড়াই বছর আগে এক সালিশের রায়ে এই সংখ্যালঘু পরিবারকে দুই বছরের জন্য ‘একঘরে’ করে রাখা সহ তাদের এক লক্ষ টাকা জরিমানাও করেন। সেই থেকে ইউনিয়নের বুড্ডা গ্রামের মাতাব্বররা সালিশে ইউপি চেয়ারম্যানের দেওয়া এ রায় বাস্তবায়ন করে আসছেন ওই সংখ্যালঘু পরিবারটির ওপর।
ভূক্তভোগী সংখ্যালঘু পরিবার ও স্থানীয় লোকজন জানান, প্রায় আড়াই বছর আগে গ্রামের সুধন মাঝির মেয়ে রুনা রাণী মাঝি একই গ্রামের উষা রঞ্জন দাসের বিবাহিত ছেলে নির্মল চন্দ্র দাসের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তারা গোপনে বিয়ে করেন। একসময় রুনা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে বিষয়টি প্রথমে দুই পরিবারে, পরে সমাজে জানাজানি হয়। একপর্যায়ে নির্মল দাসের প্রথম স্ত্রী রত্না রাণী দাস ও তাদের পরিবার বিষয়টি নিয়ে সালিশের ব্যবস্থা করেন।
গ্রামের ইউপি সদস্য অলি আহাদের বাড়িতে এ সালিশ বসে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কাজল চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সালিশে গ্রামের হিন্দু সমাজের মাতাব্বররা সহ অন্যান্য সালিশকারকগণ উপস্থিত ছিলেন। সালিশ পরিচালনা করেন ইউপি সদস্য অলি আহাদ।
সালিশে দোষী সাব্যস্ত করা হয় রুনা মাঝি এবং নির্মল দাসকে। কিন্তু সালিশের রায় আসে তাদের পরিবারের ওপর। রুনার অপরাধে তার পিতা সুধন মাঝিকে এক লক্ষ টাকা জরিমানা ও পরিবারের সকলকে দুই বছরের জন্য ‘একঘরে’ করে রাখার রায় হয় সালিশে। আর নির্মলের অপরাধে তার পিতা উষা রঞ্জন দাসকে পরিবার সহ দুই বছর ‘একঘরে’ করা সহ তার বসতভিটার দুই শতক জমি নির্মলের প্রথম স্ত্রী রত্না রাণী দাসের নামে লিখে দেয়ার রায় আসে। এই দুটি রায় দেন সালিশের সভাপতি ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কাজল চৌধুরী।
সুধন মাঝি বলেন, আমার মেয়ে রুনা গোপনে সম্পর্ক গড়ে কখন নির্মল দাসকে বিয়ে করে, এসবের আমি কিছুই জানতাম না। মেয়ে আমার অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে বিষয়টি টের পাই। এ নিয়ে সালিশ হওয়ার সপ্তাহখানেক পর রুনার পুত্র সন্তান জন্ম হয়। হৃদয় নামে ওই শিশুর বয়স এখন প্রায় আড়াই বছর। গ্রামের মাতব্বরদের চাপে রুনা তার শিশু পুত্র সহ স্বামী নির্মল দাসের সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে।
সুধন মাঝি চোখের পানি মুছতে মুছতে আরো বলেন, ওই সালিশে ইউপি চেয়ারম্যান কাজল চৌধুরী আমাকে আর্থিক জরিমানা সহ দুই বছরের ‘একঘরে’ করে সাজা দিয়ে যান। দুই বছরের সাজা ২৮ মাস যাবত খাটতেছি। টানা ২৮টি মাস আমি ও আমার পরিবারের লোকেরা বুকে পাথর বেঁধে পার করেছি। সমাজের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের কেউই আমার পরিবারের লোকদের সাথে মনখুলে কথা বলেন না। গ্রামের ধর্মীয় সহ কোনো আচার অনুষ্ঠানে আমাদেরকে দাওয়াতও দেয় না, এমনকি এসবে অংশগ্রহনেও বাধা দেয় মাতব্বররা।
কিছুদিন আগে চেয়ারম্যানের দুই পা ধরে অনেক কেঁদেছি। তখন চেয়ারম্যান গ্রামে এসে জানিয়ে গেছেন “সুধন মাঝিকে দেওয়া দুইবছরের সাজার মেয়াদ, চারমাস আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন সবাই সুধন মাঝিকে ক্ষমা করে দিয়ে সমাজে তোলে নেন।” চেয়ারম্যানের এই কথার পরও মাতব্বররা আমাদের ‘একঘরে’ রাখা সাজা মওকুফ করছেন না। তাই আর পারছি না, হয় হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করবো, না হয় পরিবারের সকলে বিষপানে আত্মহত্যা করবো।
সুধন মাঝির স্ত্রী গৌর রাণী মাঝি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে বলেন, চেয়ারম্যান ও মাতব্বররা এই সাজা দেওয়ার পর থেকে আমাদের পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করে আসছে। বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেলেও ছেলেকে বিয়ে করাতে পারছি না। আমার বাড়িতে কোন পূজারী আসেন না। ধর্মীয় কাজ পালনে নানা বাধা। বাড়ির ছেলে-মেয়েরা গ্রামের কারো ঘর-বাড়িতে যেতে পারে না। ২৮ মাস যাবত পরিবারের সবাইকে নিয়ে গ্রামের উন্মুক্ত পরিবেশে “জেল হাজত” খাটতেছি। জানিনা চেয়ারম্যানের দেওয়া কলঙ্কময় এই সাজা কবে শেষ হবে।
গ্রামের সালিশকারক মোঃ শামীম মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, প্রায় আড়াই বছর আগে ওই সালিশে আমিও ছিলাম। কিন্তু এই রায়ে আমি তখন একমত ছিলাম না। হিন্দু সম্প্রদায়ের মাতাব্বরদের নিয়ে আলোচনা করে ইউপি চেয়ারম্যান এ রায় দেন। এই রায় অমানবিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। তাছাড়া চেয়ারম্যান ও মাতব্বররা সালিশে দুই পরিবারকে সাজা দিলেও সালিশের ১০ দিন পর ওই মাতব্বররা উষা রঞ্জন দাসকে ক্ষমা করে সমাজে তোলে নেন। এর কিছুদিন পর উষা রঞ্জন দাস মারা যান। কিন্তু সুধন মাঝি ও তার পরিবার ২৮ মাস যাবত এই সাজা ভোগ করে আসছেন।
গ্রামের দিপু দাস, নান্টু চন্দ্র দাস, মোঃ শাহজাহান মিয়া, বিশ্ব চন্দ্র দাস সহ অনেকে জানান, আড়াই বছর আগের ওই সালিশে উল্লেখযোগ্য সালিশকারক ছিলেন, ইউপি চেয়ারম্যান কাজল চৌধুরী, ইউপি সদস্য অলি আহাদ, গ্রাম্য মাতব্বর রঞ্জিত দাস, লালমন দাস, লক্ষী মাস্টার, স্বপন দাস, ফানু দাস, হরিমন দাস সহ কয়েকজন সর্দার। সালিশে রায় ঘোষণা করেন ইউপি চেয়ারম্যান। এই রায়ের পর থেকে গ্রামের হিন্দু ও মুসলমান কেউই সুধন মাঝির পরিবারের সাথে কথা বলে না। তাদের সাথে কোনো সম্পর্কও গড়ে না কেউ।
সেই সালিশের সালিশকারক বুড্ডা গ্রামের মাষ্টারবাড়ির লক্ষী চন্দ্র দাস ওরফে লক্ষী মাস্টার ওই রায়ের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘আমরা নই, চেয়ারম্যান কাজল চৌধুরী এ রায় দেন, তবে এ রায়ে আমাদের সমর্থন ছিলো এবং এখনো আছে। তিনি বলেন, উষা রঞ্জন দাস সালিশের রায় মেনে বাড়ি থেকে দুই শতক জায়গা লিখে দেওয়ায় তাকে আমরা সমাজে তোলে নিয়েছি। তাছাড়া তিনি অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু সুধন মাঝির কোনো ক্ষমা নেই। চেয়ারম্যান যা করে দিয়ে গেছেন, তা-ই ঠিক থাকবে। সুধন মাঝির পরিবার ‘একঘরে’ থাকবে।
নোয়াগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কাজল চৌধুরী বলেন, দুই বছরের জন্য ‘একঘরে’ করে রাখা হয়েছিল সুধন মাঝির পরিবারকে। সালিশে হিন্দু মাতব্বররা জুরিবোর্ড করে এই রায় তারা ঠিক করেছিল। আমি সালিশের সভাপতি ও চেয়ারম্যান হিসেবে পরিস্থিতি সামাল দিতেই এ রায় ঘোষণা করি।
‘একঘরে’ থাকা সুধন মাঝির পরিবারকে আমি এরইমধ্যে নানাভাবে সহযোগিতাও করেছি। তবে আমার দেয়া রায় দুই বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু ওই গ্রামের মাস্টারবাড়ি ও ডাক্তারবাড়ির লোকেরা সুধন মাঝিকে সমাজে তোলে নিতে চাইছেন না। যার কারণে সমস্যাটি নিরসন সম্ভব হচ্ছে না।