এশিয়ায় খাদ্য অপচয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৩য়: যেখানে মাথাপিছু খাদ্য অপচয় বছরে ৬৫ কেজি
বৈশ্বিক এই টালমাটাল সংকটেও যেন থেমে নেই খাদ্য অপচয়। যেখানে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ খাদ্য আমদানি করতে হয় বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে। তারমধ্যে আমাদের খাদ্য আমদানিতে দেশের রিজার্ভ সংকট, খাদ্য উৎপাদনে করোনা সংকট ছাড়াও রয়েছে বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
বাংলাদেশে প্রতিবছর মোট উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ অপচয় হয়। অপচয়কৃত খাদ্যের আর্থিক মূল্য হিসাব করলে যেখানে দাড়ায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (FAO) এবং বাংলাদেশ ধান গবেষনা ইনস্টিটিউটের এক যৌথ গবেষনায় এ তথ্য পাওয়া যায়। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা (UNEP) ২০২১ সালে ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স নামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়েছে বাংলাদেশে বছরে এক কোটি ছয় লাখ টন খাদ্য অপচয়, সেখানে মাথাপিছু খাদ্য অপচয় দাড়ায় বছরে প্রায় ৬৫ কেজি।
আমাদের খাদ্য অপচয় কেন হয় এবং কিভাবে হয়?
যেমন বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তা খাদ্য গ্রহন করা পর্যন্ত খাদ্যের বিশাল একটি অংশ বিভিন্ন ভাবে অপচয় হয়। মাঠ থেকে খাদ্য উৎপাদন ও সংগ্রহের পর সব খাদ্য আমাদের খাবার টেবিল পর্যন্ত আসার সুযোগ পায় না। খাদ্য সংগ্রহের পর বাজারজাত করন সেখানেও রয়েছে অপচয়ের একটি বিশাল অংশ। খাদ্য মজুদে সঠিক রক্ষণাবেক্ষনের ব্যবস্থা না থাকার কারনে ব্যবসায়ীরা খাদ্য শস্য বিক্রির পর অবশিষ্ট খাদ্য শস্য ফেলে দেয়, আর না হয় রেখে দিলে সেগুলো কিছুদিন পর নষ্ট হয়ে যায়। আবার একজেলা থেকে যখন অন্য জেলায় পরিবহন করা হয় তখন খাদ্যের বিশাল একটি অংশ অপচয় হয়। আন্তর্জাতিক খাদ্য ও কৃষি সংস্থা FAO এর গবেষনায় দেখা গেছে, শষ্যদানা মানে চাল, গম ও ডাল এসব উৎপাদন থেকে মানুষের খাবার টেবিল পর্যন্ত আসার আগেই প্রায় ১৮ শতাংশ খাদ্য অপচয় হয়। এছাড়াও ফল আর সবজির ক্ষেত্রে অপচয় হয় প্রায় ১৭ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজার জাত করা পর্যন্ত যে অপচয় হয় তাকে ফুড লস্ট বলে। আবার খাবার বাড়িতে ও রেস্তোরা এবং কমিউনিটি সেন্টারে যে খাদ্য অপচয় হয় তাকে ফুড ওয়েস্ট বলে।
গবেষনায় আরোও দেখা যায় বাংলাদেশের রেস্টুরেন্ট গুলোতে যখন উচ্চ বা ধনী পরিবারের ব্যাক্তিরা যায় তখন প্রয়োজনের চেয়ে অধিক খাবার অর্ডার করে থাকে, যার বেশির ভাগ খাবার অপচয় হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের কমিউনিটি সেন্টার গুলোতে যখন কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় তখন প্রয়োজনের চেয়ে দ্বিগুণ খাবারের প্রস্তুত করা হয়, যার বেশির ভাগই খাবার অপচয় হয়ে যায়। এছাড়াও দেশের চলমান কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য হোস্টেল গুলোতে প্রতিদিন যে পরিমান খাবারের আয়োজন করা হয় তার ছোট একটা অংশ বা চার ভাগের এক ভাগ খাবার অপচয় হয়।
ব্যাক্তি জীবনে খাদ্য অপচয় কীভাবে হয়?
অপচয়ের আরো একটি বড় অংশ হচ্ছে বাংলাদেশের বেশির ভাগ পরিবার প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত বাজার করে থাকে। যার মধ্যে বেশির ভাগ খাবারই অধিক দিন সংরক্ষন করা যায় না। এইসব খাবার নষ্ট হয়ে গেলে ফেলে দেওয়া হয় যা হচ্ছে অপচয়। আবার প্রায় প্রতিটি পরিবারই দৈনিক যে পরিমান খাবার প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি খাবার রান্না করে থাকে, যা পরবর্তিতে খাওয়ার আগ্রহ থাকে এবং অতিরিক্ত খাবারের জায়গা হয় ডাষ্টবিনে। গবেষনায় আরো দেখা যায় বাড়িতে খাবার অপচয়ের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে উচ্চ আয়ের বা ধনী পরিবারগুলো। তথ্য বিশ্লেষণে ও অনুসন্ধান করে দেখা যায়, বাংলাদেশে বিশেষ করে বিয়ে বাড়িতে, সুন্নতে খাৎনা বা মৃত্যু বার্ষিকীতে যে পরিমান খাবারের আয়োজন করা হয়, সেখানেও রয়েছে খাদ্যের অপচয় একটি অংশ। উচ্চ পরিবারের ছেলে-মেয়েরা পাবে অথবা নাইটক্লাব গুলোতে আনন্দ ফুর্তির নামে অপচয় করছে খাদ্যের বিশাল একটি অংশ।
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্টিকালচার বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান জানান, দেশের উচ্চ আয়ের ছোট একটি পরিবার প্রতি মাসে প্রায় ২৬ কেজি খাবার অপচয় করে। এ বিষয়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) প্রকাশ করেন যে, বিশ্বে প্রতিবছর ১৪০ কোটি টন খাদ্য অপচয় হয়। এই অপচয় হওয়া খাবার বিশ্বের মোট খাদ্য জোগানের এক-তৃতীয়াংশ। যা দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ২০০ কোটি খুধার্ত মানুষকে পেট ভরে খাওয়ানো সম্ভব।
দেশের খাদ্য অপচয়ের পরিমাণ
বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির খাদ্য অপচয় সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ফসলের মাঠ থেকে গৃহিনীর রান্নাঘর পর্যন্ত খাবার আসতে প্রতিবছর দেশে ৩৭ লাখ টনের বেশি খাবার নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে বাড়িতে খাবার অপচয়ের বার্ষিক পরিমাণ প্রায় ১.০৭ কোটি টন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘের তথ্যমতে, অপচয় নাহলে এই খাদ্য দিয়ে দেশের ১৬ কোটি মানুষকে প্রায় তিন মাস খাওয়ানো সম্ভব।
জাতিসংঘের গবেষনায় বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের খাবার অপচয় হয়। ২০১৮ সালে করা জাতিসংঘের এক গবেষনায় দেখা যায় আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ সারাবিশ্বে খাদ্য অপচয়ের পরিমান ২০০ কোটি টনে পৌঁছাবে।
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচিতে প্রকাশিত খাদ্য অপচয় সূচক এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করে যে, বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১০০ কোটি টন খাদ্য অপচয় হয়। এ প্রতিবেদনটি খাদ্য অপচয় নিয়ে এযাবৎকালের সবচেয়ে বিস্তৃত প্রতিবেদন। প্রতিবেদনে আরোও বলা হয়েছে বিশ্বে প্রতি বছর একজন মানুষ বাড়িতে গড়ে ৭৪ কেজি খাবার অপচয় করে, এছাড়াও ভোক্তার কাছে যাওয়া খাদ্যের ১৭শতাংশ বাড়ি, খুচরা দোকানদার, রেস্তোরা কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ডাস্টবিনে ফেলা হয়। বৈশ্বিকভাবে মাথা পিছু খাদ্য অপচয় গড়ে ১২১ কেজি, যার বেশির ভাগ খাবারই অপচয় হয় আমাদের বাড়িতে।
অপচয় কৃত এই খাদ্য যে শুধু খাদ্যের সংকট বা অর্থনৈতিক ঘাটতি সৃষ্টি করছে তা নয়।এই অপচয় কৃত খাদ্য পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে উঠছে।অপচয় কৃত এসব খাদ্য পচে গিয়ে তৈরি করছে মিথেন গ্যাস যা পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর।খাদ্য পচে গিয়ে পরিবেশ দূষিত করে যার ফলে বায়ুতে কার্বনডাইঅক্সাইড এর পরিমান বেরে যায়।তাতে করে পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর আশংকা বেরে যায়।পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে তার পাশাপাশি প্রাকৃতিক সম্পদের এবং শক্তির অপচয় হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে ব্যাক্তিই মূলত খাদ্য অপচয়ের জন্য দায়ী এমনটাই মনে করছেন বিশেষঙ্গরা।
কিভাবে খাদ্য অপচয় রোধ করা যায়?
বাংলাদেশের রেস্টুরেন্ট এবং কমিউনিটি সেন্টারে যে পরিমান খাবার অপচয় হয় তা যদি দুস্তদের মাঝে,এতিম খানা এবং বিদ্ধাশ্রম ও চাইল্ড কেয়ার একাডেমী বা সংস্থা গুলোর মাঝে যদি বিতরন করা হয় তাহলে বিপুল পরিমান খাদ্য অপচয় রোধ হবে।
অন্যদিকে উচ্চ আয়ের পরিবারে যে পরিমান খাদ্য অপচয় হয় তা যদি নিম্নবিত্ত বা অসহায় গরিব দুঃখী এবং রাস্তার পথশিশুর মাঝে বিতরন করে দেওয়া হয় তাহলে খাদ্য অপচয় অনেকটাই কমে আসবে।
খাদ্যমমন্ত্রী বলেন আইন করে খাদ্য নষ্ট বন্ধ করার চেষ্টা কতটা সফল হবে,তা বলতে পারব না।তবে প্রথমে মানুষকে সচেতন করতে হবে, যে ক্ষুধার্ত মানুষ এ খাদ্য খেয়ে জীবন ধারন করতে পারে।সবচেয়ে বড় কথা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্টের যেমন দায়িত্ব আছে তেমনি প্রত্যেক মানুষকে নিজ নিজ অবস্থা থেকে কাজ করতে হবে।
খাদ্য অপচয় রোধে কিছু পদক্ষেপ গ্রহনের মাধ্যমে আমরা বিপুল পরিমান খাবার নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচাতে পারি।যেমনঃ