প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় আইলার ১৩ বছরে আজও ক্ষত মুছতে পারেনি উপকূলবাসী। ঘূর্ণিঝড় আইলা ২০০৯ সালে উত্তর ভারত মহাসাগরে জন্ম নেয়া দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড়টি জন্ম নেয় ২১ মে ভারতের কলকাতা থেকে ৯৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে। ঘুর্ণিঝড়টি আঘাত হানে ২৫ মে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে।
এ দিনে আইলা খুলনার পাইকগাছা-কয়রাসহ গোটা উপকূলী লন্ডভন্ড করে ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। বিস্তীর্ণ জনপদের বিভিন্ন এলাকায় পাউবোর দুর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম লবণ পানিতে তলিয়ে যায়। এতে বহু কাঁচা-পাকা ঘর বাড়ি, ফসলের ক্ষেত ও মাছের ঘের ভেসে গিয়ে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়। হাজার হাজার গবাদি পশুর মৃত্যু হয়।
উপকূলজুড়ে অর্থনীতিতে পড়ে বিরূপ প্রভাব। আইলা উদ্বাস্ত বহু মানুষ গৃহহারা হয়ে রাস্তার উপর আশ্রয় নেয়। শ্রমজীবী পরিবারে খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। দেখা দেয় সুপেয় পানির সংকট। জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে গোটা এলাকা। বিভিন্ন রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মুখে পড়ে উপকূলের লাখ লাখ মানুষ। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন দাতা সংস্থা, এনজিও, সামাজিক, রাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দুর্যোগকবলিত মাানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসেন।
এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়রা সফরকালে বাগালিতে জনসভায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ উপকূলীয় অঞ্চলে টেঁঁকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সবুজ বেষ্টনি গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। আইলা পরবর্তী গত ১৩ বছরে অবস্থার উত্তরণ হলেও এর ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারেননি অনেকেই।
এখন পর্যন্ত পাউবো দ্রুত উপজেলায় ঝুঁকিপূর্ণ ফোল্ডার অভ্যন্তরে জরুরি ভিত্তিতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলেও পরবর্তী ফণি, আম্ফান ও ইয়াসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোতে সেই বাঁধ টেকেনি। এসব দুর্যোগে এমনকি জোয়ারের অতিরিক্ত পানির চাপে পাইকগাছা ও কয়রার বিভিন্ন ফোল্ডারে বেড়িবাঁধ ভাঙনে ঐসব এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে।
এতে স্থানীয়রা অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষে বেড়িবাঁধ ও স্লুইচগেটগুলোর অপব্যবহারকে দায়ী করে লবণ পানিবিরোধী জনমত গড়ে তোলেন। ইতোমধ্যে অনেক এলাকায় লবণ পানির পরিবর্তে মিঠা পানিতে মাছ চাষের পাশাপাশি ধানসহ নানা মৌসুমি ফসল উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন অনেকেই। সব মিলিয়ে গতি ফিরেছে সার্বিক অর্থনতিক উন্নয়নে।
এদিকে, অভিযোগ ওঠে উপকূলীয় অঞ্চলে সরকারের ব্যাপক পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন মজবুত ও টেঁকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে না পারা নিয়ে। তবে সর্বশেষ সরকার কয়রায় টেঁকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে সরকারসহ ইউএনডিপি এখন পর্যন্ত দুই উপজেলায় প্রায় দশ হাজার পানির ট্যাঙ্ক সরবরাহ করেছে। এখনও আসার অপেক্ষায় রয়েছে প্রায় সাত হাজার জলাধার। দুই উপজেলায় ৪০টি পুকুর খনন করা হয়েছে। ৩০০টি নলকূপ ও ১০টি সোলার পিএস স্থাপন করা হয়েছে।
পাইকগাছার জলাবদ্ধতা নিরসনে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নাছিরপুর ৯ ও পোদা নদী ৭ কিলোমিটার খাল খননের কাজ শুরু হয়েছে। শালিখা হতে আমাদী পর্যন্ত ৩২ কি.মি. কপোতাক্ষ নদ খনন প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। তবে নানা জটিলতায় অনেক খাল খনন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এর জন্য অবশ্য কতিপয় চিংড়ি চাষী ও প্রভাবশালীরা দায়ী বলে মনে করছে মৎস্য অধিদপ্তর। সর্বশেষ ক্ষত মুছতে আইলার ১৩ বছরে ঘুরে দাঁড়ানোর নিরন্তন চেষ্টা করছে সুন্দরবন উপকূলীয় পাইকগাছা-কয়রার মানুষ।