সালথা তাণ্ডবের এক বছর। এখনো চলছে পুলিশি তদন্ত ফরিদপুরের সালথার নজিরবিহীন সহিংসতার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল রাতে লকডাউন কার্যকরের অভিযানকে কেন্দ্র করে উত্তেজিত জনতা উপজেলা সদরের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করে।
বিভিন্ন দপ্তরে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগে প্রায় তিন কোটি টাকার সরকারি সম্পদ নষ্ট ঘটে। নিহত হয় দুজন। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে পৃথক ৮টি মামলা দায়ের করেছিল। এর মধ্যে ডিজিটাল আইনে দায়েরকৃত একটি মামলা ছাড়া অন্য মামলাগুলোর এখনো তদন্ত শেষ হয়নি। ফলে এখনো দাখিল হয়নি পুলিশি প্রতিবেদন।
এসব মামলা ঘিরে এখনো এলাকা ছাড়া রয়েছে সালথা উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ। এতে অতিকষ্টে দিন কাটাচ্ছে কয়েক শ’ পরিবার।
যেখানে ঘটনার সূত্রপাত, সেই ফুকরা বাজারের সবগুলো দোকানপাট বন্ধ রয়েছে গত এক বছর ধরে। এতে ৮০-৯০ লাখ টাকার দোকানের মালামাল নষ্ট হয়েছে বলে এলাকাবাসী ধারণা করছে। এই ঘটনার কিছু মূলহোতা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। তারা সালথা উপজেলাতেই ঘোরাফেরা করেন বলে অনেকেই মনে করেন।
গত বছরের ৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় করোনা মোকাবিলায় কঠোর বিধিনিষেধ কার্যকর করতে দুই আনসার সদস্য ও ব্যক্তিগত সহকারী নিয়ে তৎকালীন সালথা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মারুফা সুলতানা হিরামণি স্থানীয় ফুকরা বাজারে যান। সেখানে অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পেয়ে সালথা থানার এস আই মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে গেলে হামলার শিকার হয়।
পরে স্থানীয় জনতা ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। এর জের ধরে রাত সাড়ে ৭টা থেকে ১২টা পর্যন্ত সালথা উপজেলা পরিষদ, থানা, সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবন, উপজেলা কৃষি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসভবন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এসময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সালথা থানার পাশাপাশি ফরিদপুর, বোয়ালমারী, ভাঙ্গা ও নগরকান্দা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব পৌঁছে মুহুর্মুহু ফাঁকা গুলি, রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে। এরপর রাত ১২টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আট সদস্যসহ আহত হন ২০ জন। আহতদের মধ্যে জুবায়ের হোসেন (২৫) ও মিরান মোল্যা (৩৫) নামের দুই যুবক চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সহিংসতার এ ঘটনায় সালথার বিভিন্ন সরকারি ভবন ও স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রায় তিন কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। ওই সহিংসতার ঘটনায় কয়েক হাজার মানুষকে আসামি করে ৮টি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে ৭টি মামলা সালথা থানা পুলিশ ও একটি মামলা ডিবি পুলিশ তদন্ত করছে।
মামলায় এজাহারনামীয় ৩৮১ এবং সন্দেহভাজন ১৪৬ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন ২২ জন। একজন আসামি আটকাবস্থায় মারা যায়।
সালথার ঘটনায় পুলিশ বাদী মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এস আই মো. হান্নান মিয়া বলেন, সালথার সহিংসতার ঘটনায় পুলিশ বাদী হওয়া মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সহিংসতার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতে পুলিশ প্রতিবেদন পাঠানো হবে।
সালথার তাণ্ডবের পর ডিজিটাল আইনের মামলার বাদী এস আই গোলাম মোন্তাছির মারুফ বলেন, ফেসবুক পেজ পেট্রোলিং করে সালথার ঘটনার সাথে ডিজিটাল মাধ্যমে যে সকল ব্যক্তিরা অপরাধের সাথে জড়িত ছিল; তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলাটি ডিবি তদন্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে।
সালথা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে হামলার মামলার বাদী বীর মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু মাতুব্বর বলেন, সালথার সহিংসতার ঘটনার কিছু মূলহোতা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। তারা প্রতিদিন সালথা থানা পুলিশের সামনে দিয়ে উপজেলায় ঘোরাফেরা করেন।
আটককৃত আসামি যারা জামিনে এসেছেন, তাদের মুখে আমরা শুনেছি যে আমরা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে যাদের নাম বলেছি পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার করছে না। আমি আশা করবো, পুলিশের অভিযোগপত্রে তাদের নাম থাকবে এবং তারা আইনের আওতায় এসে এই ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানোর শাস্তি পাবে।
ফরিদপুরের সহকারী পুলিশ সুপার (নগরকান্দা-সালথা সার্কেল) সুমিনুর রহমান বলেন, সালথার সহিংসতার ঘটনায় পুলিশ অত্যন্ত সঠিকভাবে দ্রুততার সঙ্গে ঘটনাগুলো তদন্ত করছে। যাতে কোন অপরাধী ছাড় না পায়, একই সাথে কোন নিরপরাধ ব্যক্তি সাজা না খাটে; সেদিকে খেয়াল রেখে তদন্ত কার্যক্রম অনেকদূর এগিয়ে নেওয়া হয়েছে।
পুলিশ মামলাগুলো নিয়ে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে। এর মধ্যে ডিজিটাল আইনে করা মামলা তদন্ত করে ডিবি পুলিশ অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। বাকি মামলাগুলোর অভিযোগপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।