অবস্থান: রংপুর জেলার তাজহাট , ডিমলা, কাকিনা, মন্থনা, পীরগঞ্জ, বর্ধনকোট ইত্যাদি এলাকায় বেশ কিছু বিখ্যাত জমিদার বংশ ছিল। তাঁদের ছিল বিশাল আয়তনের সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ, যার মধ্যে তাজহাট জমিদার বাড়ি সর্বাধিক বিখ্যাত। প্রাসাদটি রংপুর শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দক্ষিণ পূবের্ বর্তমান কৃষি ইনস্টিটিউটের পাশে সবুজ গাছপালা পরিবেষ্টিত আকর্ষণীয় পরিবেশে অবস্থিত।
জমিদার বাড়ির ইতিহাস: শিখ ধর্ম থেকে হিন্দু ধর্মে ধমান্তরিত মান্নালাল রায় ছিলেন তাজহাট জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি পাঞ্জাব থেকে এদেশে আসেন এবং রংপুরের মাহিগঞ্জ বসবাস শুরু করেন। সে সময় মাহীগঞ্জ ছিল রংপুরের জেলা সদর। তিনি ছিলেন পিশায় ¯^র্ণাকার। ধারণা করা হয় তার আকর্ষনীয় “তাজ” বা “রতœ” খচিত মুকুটের কারণে এই এলাকার নামকরণ হয় তাজহাট। মান্নালাল রায় তার জীবদ্দশায় অনেক ভূ-সম্পত্তির মালিক হন এবং ক্রমশঃ রংপুরের অনেক এলাকা নিজের আয়ত্বে নিয়ে আসেন। তার নাতি ধনপত লাল রায় বিয়ে করেন নয়া দুমকার রতন লাল রায়ের নাতনীকে। রতন লাল রায় ও পাঞ্জাব থেকে অভিবাস গ্রহণ করেন। ধনপত রায়ের নাতি উপেন্দ্রলাল রায় অল্প বয়সে মারা যাবার কারণে জমিদারীর দায়িত্ব তার কাকা “মুনসেফ” গিরিধারী লাল রায়ের হাতে এসে পড়ে। নিঃসন্তান হওয়ার কারণে তিনি কোলকাতার জনৈক গোবিন্দ লালকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন। গোবিন্দ লাল ১৮৮৯ সালে এই জমিদারীর উত্তরাধিকারী হন। তিনি ছিলেন খুবই ¯^াধীনচেতা এবং জনপ্রিয়। ফলে তিনি ১৮৮৫ সালে “রাজা” ১৮৯২ সালে “রাজা বাহাদুর” এবং ১৮৯৬ সালে “মহারাজা” উপাধি গ্রহণ করেন। ১৮৯৭ এর ভূমিকম্পে নিজ বাড়ি ধংসস্তুপের নীচে পড়ে তার মৃত্যু হয়। ১৯০৮ সালে তার ছেলে মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় জমিদারীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
জমিদার বাড়ির বিবরণ: পূর্বেমুখী দোতলা এ বিশাল প্রাসাদটির দৈর্ঘ্য ৭৬.২০ মিটার। বিদেশ থেকে আনা সাদা মার্বেল পাথরে তৈরী ১৫.২৪ মিটার প্রশস্ত কেন্দ্রীয় সিঁড়িটি সরাসরি দোতলায় চলে গিয়েছে। সেমি-করিন্থীয় স্তম্ভ দ্বারা সমর্থিত আটকানো বিশিষ্ট ড্রামের উপর স্থাপিত গুম্বুজটি প্রাসাদের মাঝ বরাবর ছাদেও কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। সিঁড়ির উভয় পাশে দোতলা পযর্ন্ত ইটালীর মার্বেলের ধ্রæপদী রোমান দেব দেবীর মূর্তী দ্বারা সজ্জিত ছিল। সেগুলো অনেক আগেই হারিয়ে গিয়েছে। প্রাসাদের সম্মুখ ভাগে দু’প্রান্তে সেমি-আটকানো উদ্গত ও মধ্য ভাগে একটি ৯.১৪ মিটার বারান্দা আছে। উক্ত বারান্দার ছাদের উপরে চারটি সুসজ্জিত করিন্থীয় স্তম্ভ ও চাল বিশিষ্ট দুটি কক্ষ আছে। প্রাসাদ অভ্যন্তরের পুরোভাগ জুড়েই আছে ৩ মিটার প্রশস্ত বারান্দা। তাছাড়া উপর তলার ওঠার জন্য প্রাসাদে কাঠের দুটি সিড়ি রয়েছে। সিড়ি দুটির উভয় বাহর মধ্যবর্তী স্থানে অপরটি পূর্ব বাহর দক্ষিণ প্রান্ত। এ প্রাসাদে ২২টি কক্ষ আছে।
ধারণা করা যায়, বিংশ শতকের শুরুর দিকে মহারাজা কুমার গোপাল রায় এই প্রাসাদ নির্মাণ করেন। ১৯৮৪ সালে থেকে ১১৯১ সাল পযর্ন্ত প্রসাদটি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোট বেঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৯৫ সালে প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তর ইমারতটিকে সংরক্ষিত পুরার্কীতি হিসেবে ঘোষণা করেন। এই প্রাসাদের অনন্য স্থাপত্যিক গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার ২০০২ সালে এখানে রংপুর জাদুঘর স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তদানুযায়ী ২০০৫ সালে থেকে এই প্রাসাদের অংশ বিশেষ “রংপুর জাদুঘর” হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: তাজহাট জমিদার বাড়ি সপ্তাহে বরিবার অর্ধদিবস ও সোমবার ব্যতীত প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫ টা পযর্ন্ত খোলা থাকে। এখানের প্রবেশের নির্দিষ্ট ফি বর্তমান ২০ টাকা।