কসময় বাতিল বা ফেলে দেয়ার জিনিস হিসাবে বিবেচনা করা হতো, এমন কিছু পণ্যই এখন বৈদেশিক মুদ্রা আনতে শুরু করেছে বাংলাদেশে। বিদেশের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে রীতিমত শিল্প আকারে এসব পণ্যের সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানির ব্যবসা শুরু হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ এসব ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।
অথচ এসব ব্যবসার বেশিরভাগই বাংলাদেশে শুরু হয়েছে গত দুই দশকের মধ্যে।
করোনাভাইরাসের কারণে অনেকটা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মতো রপ্তানিমুখী এসব ব্যবসা বড় ক্ষতির মুখোমুখি হলেও এখন আবার সেটা কাটিয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছেন উদ্যোক্তারা।
মাছের আঁশ
মাছে-ভাতে বাঙালি হিসাবে পরিচিত বাংলাদেশের মানুষের কাছে মাছ বরাবরই জনপ্রিয় থাকলেও, মাছের আঁশের কোন কদর ছিল না।
কিন্তু প্রায় দেড় দশক আগে থেকে এই ফেলে দেয়া পণ্যটি রপ্তানি আয় আনতে শুরু করেছে। এখন বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ২০০ কোটি টাকার বেশি মাছের আঁশ সাত-আটটি দেশে রপ্তানি হয়।
দুই হাজার আট সালে মাছের আঁশ রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন ঢাকার যাত্রাবাড়ীর শামসুল আলম।
তিনি বলছেন, ”সেই সময় আমার একজন বন্ধু সিএন্ডএফের এজেন্ট ছিল। তার একজন জার্মান ক্রেতা তাকে বললেন যে, আমাদের মাছের আঁশ লাগবে, দেখো তো তোমরা এটা রপ্তানি করতে পারো কিনা। সেই বন্ধুর কাছ থেকে পরামর্শ পেয়ে আমি আঁশ সংগ্রহ করার কাজ কাজ শুরু করি।”
সেই থেকে তিনি এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। যদিও প্রথম দিকে মানুষ এ ব্যাপারে সচেতন না হওয়ায় পুরো এক বছর ধরে চেষ্টার পর মাত্র ৬০ টন আঁশ সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন।
এরপর আস্তে আস্তে সারা দেশে তাদের একটি সাপ্লাই চেইন গড়ে ওঠে।
আরেকজন রপ্তানিকারক জুলফিকার আলম বলছেন, বাংলাদেশে এখন প্রায় প্রতিটি বাজারে যারা মাছ কাটেন, তারা সবাই আর আঁশ ফেলে না দিয়ে সংগ্রহ করে রেখে দেন। সারা দেশ থেকেই আমরা আঁশ সংগ্রহ করি। এক সময় যে পণ্যটি ফেলে দেয়া হতো, সেটি থেকে আমরা এখন রপ্তানি আয় করছি।
তাদের কাছ থেকে পাইকারি ক্রেতারা এসব আঁশ সংগ্রহ করে ময়লা দূর করে ধুয়ে শুকিয়ে নেন। এরপর রপ্তানিকারকরা সেগুলো প্রক্রিয়া করে বিদেশে রপ্তানি করেন। যদিও মাত্র ১০-১২ জন ব্যক্তি আঁশ রপ্তানি করেন, কিন্তু সব মিলিয়ে এই ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ।
এখন বাংলাদেশ থেকেই প্রতি বছর প্রায় আড়াই হাজার টন আঁশ রপ্তানি হয় জাপান, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোয়।
সেখানে মাছের আঁশ থেকে কোলাজেন ও জিলেটিন তৈরি করা হয়। ওষুধ, প্রসাধন সামগ্রী, ফুড সাপ্লিমেন্ট তৈরিতে মাছের আঁইশ ব্যবহৃত হয়। এছাড়া কোলাজেন ও জিলেটিন মাছের আঁইশ দিয়ে তৈরি হয়, যা ওষুধ ও প্রসাধন সামগ্রীতে কাজে লাগে।
জুলফিকার আলম বলছিলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময় দুই বছর রপ্তানি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন তবে আস্তে আস্তে আবার অর্ডার আসতে শুরু করেছে, তবে আগের মতো ব্যবসায় এখনো শুরু হয়নি।
বাতিল সুতার বিশাল ব্যবসা
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নানা আনুষঙ্গিক ব্যবসার জন্ম হয়েছে।
এমনকি এই শিল্পের বাতিল পণ্যের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে বিশাল ব্যবসা, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।
নওগাঁ, বগুড়া ও জয়পুরহাটের তিনটা জেলায় বাতিল সুতার ওপর ভিত্তি করে বিশাল কুটির শিল্প তৈরি হয়েছে। বগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার নসরতপুর ইউনিয়নের শাওল বাজারে শুধু এসব পরিত্যক্ত সুতার বিশাল একটি বাজার তৈরি হয়েছে।
সারা দেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলোর পরিত্যক্ত সুতা এখানে নিয়ে আসা হয়। তার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সুতা থাকে-কটন, নাইলন, পলিয়েস্টার, উল- বহু ধরনের সুতা থাকে। সেখানে এসব সুতা আলাদা আলাদা করা হয়। অর্থাৎ কটনের সঙ্গে কটন মেলানো হয়, পলিয়েস্টারের সঙ্গে পলিয়েস্টার।
এরপর ওই এলাকায় কোন কোন রঙের চাহিদা আছে, সেগুলো আলাদা করে রাখা হয়। অন্যান্য রঙের যেসব সুতা বাকি থাকে, সেগুলোকে আবার ডায়িং বা রঙ করার জন্য পাঠানো হয়।
এরপর এসব সুতা কিনে নেন এসব জেলার তাঁতিরা।
তারা চরকা বা নাটাইয়ের সাহায্যে আলাদা আলাদা করা হয়। এরপর কেজি আকারে বিক্রি হয়। এসব সুতা ১২০ টাকা থেকে শুরু করে মান ভেদে ৭০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
শাওল বাজারেই সুতা নির্ভর তিন হাজার দোকান রয়েছে।
ফজলুল হক মিয়া জানাচ্ছেন, এসব জেলায় ১০ হাজারের বেশি তাঁতি রয়েছে। তাদের কেউ কম্বল, কেউ বিছানার কাপড়, শাল চাদর, গামছা বা লুঙ্গি তৈরি করেন। তারা সবাই এখান থেকে পরিত্যক্ত সুতা কিনে গিয়ে তাতে বুনে নতুন নতুন পণ্য তৈরি করেন।
কয়েক দশক ধরে এই তাঁতিরা বংশ পরম্পরায় কাপড় বুনে থাকেন। তবে এক সময় দূর দূরান্ত থেকে তাদের সুতা কিনে আনতে হতো কিন্তু তুলা থেকে নিজেদের তৈরি করে নিতে হতো। কিন্তু আশির দশক থেকে তৈরি পোশাকের পরিত্যক্ত সুতা সহজলভ্য হয়ে ওঠায় তাদের কাজ সহজ হয়ে গেছে।
এক সময় এই এলাকার তাঁতিরা হাতের তাঁতে কাজ করতেন। তবে এখন এই বেসরকারি সংস্থাটি চেষ্টা করছে, হাতের বদলে তাতিরা যেমন বিদ্যুৎচালিত তাঁত ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমে তাদের কাজ যেমন নিখুঁত হয়, তেমনি অল্প সময়ে তারা বেশি কাপড় তৈরি করতে পারেন।
ছাই থেকে বৈদেশিক মুদ্রা
ছাই উড়িয়ে অমূল্য রতন পাওয়ার কবিতা বা প্রবাদ চালু থাকলেও, ছাই বিক্রি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব, দুই দশক আগে সেটা কেউ চিন্তাও করেনি।
কিন্তু শুধুমাত্র ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ছাই রপ্তানি করেই বাংলাদেশের আয় হয়েছে তিন কোটি ২১ লাখ ৮৭ হাজার ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা।
তবে রপ্তানিযোগ্য ছাইয়ের কয়েকটি ধরন রয়েছে।
ইস্পাত কারখানাগুলোয় চুল্লির ধোঁয়া আটকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ছাইয়ে রূপান্তর করা হয়। ২০১২ সালে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি কোম্পানি বিএসআরএম প্রথম এই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করে। একে স্টিল ডাস্টও বলা হয়।
এখন প্রায় সবগুলো বড় ইস্পাত কোম্পানি এই ব্যবসায় জড়িত হয়েছে। চীন, ভারত, স্পেন, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক ইত্যাদি দেশে এই ছাই রপ্তানি হয়।
এগুলো মূলত কালি ও প্রিন্টারের কার্টিজ তৈরির কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
এর বাইরে পাটকাঠি থেকে তৈরি করা অ্যাকটিভেটেড চারকোলও তৈরি হচ্ছে এবং চীনে রপ্তানি শুরু হয়েছে।
পাটকাঠিকে ৪৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় আট থেকে ১০ ঘণ্টা বিশেষ চুল্লির মাধ্যমে পুড়িয়ে এবং সেটাকে চূর্ণ করে চারকোল তৈরি করা হয়। এছাড়া ধান ভাঙ্গানো তুষও চারকোল করা হয়।
রাজশাহী, গাজীপুর, রাজবাড়ী, জামালপুর, পাবনা, ফরিদপুরে বাণিজ্যিকভাবে চারকোল তৈরি করা হচ্ছে।
এসব চারকোলে থাকা কার্বনের বিদেশে চাহিদা রয়েছে।
এ দিয়ে ফটোকপিয়ার ও প্রিন্টারের কালি, ওষুধ, দাঁত পরিষ্কারের সামগ্রী, পানির ফিল্টার তৈরি করা হয়।
মাছ কাটা, থালাবাসন মাজা ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা এসব ছাই তৈরি হয় মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন চাল কলে। সেখানে তুষের ছাই পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে আনেন। ডেমরা ও কাওরানবাজারে এরকম তুষের ছাইয়ের পাইকারি বাজার রয়েছে।
এরকম একজন ছাই বিক্রেতা মতিউর রহমান বলছেন, ”মাছ কাটতে, ঘরবাড়ির বাসন মাজতে ছাই লাগে। আমরা মু্সিগঞ্জ থেকে এনে পাইকারি বিক্রি করি। প্রতি বস্তা ১৫০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে।”
সেখান খুচরা বিক্রেতারা ছাই কিনে এনে ফেরি করে পাড়া মহল্লা বা মাছ বাজারগুলোয় বিক্রি করেন।
ফেলে দেয়া চুলের ব্যবসা
স্যালুন বা পার্লারে গিয়ে চুল কাটানো বহু পুরনো ঘটনা হলেও, সেই কাটানো চুল বা ফেলে দেয়া চুল হয়ে উঠেছে অনেকের জীবিকার উৎস।
শুধু দেশের বাজারেই নয়, এসব চুল থেকে প্রতি বছর শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রাও আসছে।
এসব চুল দিয়ে উইগ বা পরচুলা তৈরি করা হয়। বাংলাদেশেই এখন উইগের রীতিমত কারখানা তৈরি হয়েছে।
ঢাকার কলাবাগানের একটি বিউটি পার্লারের মালিক তাহমিনা আক্তার বলছেন, ”বড় চুল কাটা হলে মেয়েরা সংগ্রহ করে রাখে। প্রতি সপ্তাহেই লোকজন এসে এই চুল নিয়ে যায়। আমরা আগে ঝাড়ু দিয়ে চুল ফেলে দিলেও এখন অবশ্য সংগ্রহ করে রেখে দেই।”
অনেকেই ফেরি করে স্যালুন বা বিউটি পার্লার থেকে ফেলে দেয়া চুল সংগ্রহ করেন। এমনকি পাড়া বা মহল্লায় চুল কিনতে ফেরিওয়ালাদের ঘুরতেও দেখা যায়।
তারা এসব চুল সংগ্রহ করে উইগ বা পরচুলা তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিক্রি করেন।
ঢাকার খিলগাঁয়ে পরচুলা তৈরির একটি কারখানা রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন স্যালুন বা বিউটি পার্লার থেকে সংগ্রহ করা চুল দিয়ে পরচুলা বা উইগ তৈরি করা হয়।
হেয়ারি উইগের মালিক মতিউর রহমান ২২ বছর আগে এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তখন দোকানে দোকানে গিয়ে তিনি ফ্যাশন ডলের মাথায় উইগ বসানোর জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতেন। আর এখন তার কাছে প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসছেন উইগের খোঁজে।
মতিউর রহমান বলেন, “এখন বিভিন্ন বয়সের মানুষেরা আসছেন নিজেদের মাথার উইগ বা পরচুলা তৈরির জন্য। কেউ চাকরির ইন্টারভিউ দেবেন বা বিয়ের পাত্রী দেখতে যাবেন, আবার কেউ টেলিভিশনে খবর পরবেন এমন অনেকে নিচ্ছেন উইগ। এছাড়া দেশের বাইরে থেকে তাদের কাছে অর্ডার আসছে।”
কাটা চুল কেজি প্রতি তিন-চার কিংবা ৫০০০ টাকাতেও বেচা-কেনা চলছে। তবে চুলের আকার হতে হবে আট ইঞ্চি লম্বা।
বর্তমানে কোনও কোনও কোম্পানি এই চুল আইল্যাশ বা চোখের পাপড়ি তৈরিতে ব্যবহার করছে।
আর বিভিন্ন বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা চুল প্রক্রিয়াজাত করা ছাড়াও চলে যাচ্ছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। শত-কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আসছে ফেলনা এসব এসব চুল রপ্তানি করে। ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের বাইরে সবচেয়ে বেশি এ ধরনের চুল যাচ্ছে ভারতে।
রাজশাহী নওগাঁ, চুয়াডাঙ্গাসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক জায়গাতে ফেলে দেয়া চুল হয়ে উঠেছে অনেকের রোজগারের উৎস।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তালিকায় উইগ এবং হিউম্যান হেয়ারকে অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে বলা হচ্ছে। ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ৫৫ লাখ ডলারের বেশি এ ধরণের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা