কিশোর গ্যাং যে কত ভয়াবহ হয়ে উঠেছে তা গত ১১ জানুয়ারি পুলিশের আইজি বেনজীর আহমেদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে৷ তিনি বলেছেন, ‘‘পুলিশের জন্য এই কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধীরাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন৷’’
এই কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে পরিবারের ভূমিকাকেই সবচেয়ে বড় বলে মনে করেন পুলিশ প্রধান৷ তিনি র্যাব সদর দপ্তরের অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘পিতামাতা সন্তান জন্ম দিয়েছেন, তার দায়-দায়িত্বও আপনাকে নিতে হবে৷ দায়-দায়িত্ব যদি নিতে না পারেন, তাহলে সন্তান জন্ম দিয়েছেন কেন?’’
ডিএমপির অপরাধ পর্যালোচনার তথ্য অনুযায়ী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ৪০টির মতো কিশোর গ্যাং রয়েছে৷ প্রতিটি গ্যাং-এর সদস্য সংখ্যা ১৫-২০ জন৷ পুলিশ সূত্র জানায়, গত এক বছরে ঢাকায় অন্তত পাঁচটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারা৷ এর মধ্যে উত্তরার কিশোর গ্যাং সবচেয়ে আলোচিত৷ সেখানে একাধিক গ্যাং রয়েছে৷ ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উত্তরায় ডিসকো এবং নাইন স্টার গ্রুপের দ্বন্দ্বে নিহত হয় কিশোর আদনান কবির৷ তার পরের মাসে তেজকুনি পাড়ায় দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে খুন হয় কিশোর আজিজুল হক৷ ঢাকার বাইরে থেকেও প্রায়ই কিশোর গ্যাং-এর দ্বন্দ্বে খুনখারাবির খবর পাওয়া যায়৷
বরগুনার নয়ন বন্ড তার ০০৭ গ্রুপ নিয়ে জনসম্মুখে রিফাত শরিফকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এ হত্যার জন্যে ১১ কিশোরকে কারাদন্ড দিয়ে বরগুনার আদালত বলেছেন, ‘‘সারাদেশে কিশোর অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে৷ গডফাদাররা এই কিশোরদের ব্যবহার করছে৷’’
গত বছর সাভারে স্কুল ছাত্রী নীলা হত্যায় কিশোর গ্যাং জড়িত৷ আর ওই হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি মিজানুর রহমান কিশোর গ্যাং লিডার৷ আর তার গডফাদার স্থানীয় এক যুবলীগ নেতা৷
ওই বছরের ৯ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় দুই কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধে নাঈম নামের এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়৷ একই এলাকায় কিশোর গ্যাং-এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় গত বছরের ১ এপ্রিল শরিফ হোসেন নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷
সারাদেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও এখন কিশোর গ্যাং সক্রিয়৷ অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা তাদের ব্যবহার করেন৷ আর সেই ক্ষমতায় গ্যাংগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে৷ হত্যা ছাড়াও ধর্ষণ, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে৷
কিশোর-কিশোরীরা কথায় কথায় মেজাজ দেখাচ্ছে, অথবা কেউ ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে রাখছে৷ কেউ চুলে রং করছে বা অসম্ভব জোরে গান শুনছে৷ তার ওপর পড়াশোনায় মনোযোগ একেবারেই নেই! মাথায় যেন তাদের একটাই প্রশ্ন – ‘‘আমার বয়সি, আমার বন্ধুরা কী করছে?’’ এই অনুভূতিকে আয়ত্বে আনা টিন-এজারদের নিজেদের জন্যও কিন্তু খুব কঠিন৷ জানান জার্মনির শিশু-কিশোর বিশেষজ্ঞ ও মনশ্চিকিৎসক রমুয়াল্ড ব্রুনার৷
কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তথ্য মতে যে কিশোররা ওইসব কেন্দ্রে আছে তাদের ২০ শতাংশ হত্যা এবং ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি৷ ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সের কিশোররাই বেশি অপরাধে জড়াচ্ছে৷ কিশোররা, চুরি, ছিনতায়ের মত অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে বলে কেন্দ্রের তথ্যে জানা যায়৷
পুলিশের সাবেক আইজি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নূর মোহাম্মদ জানান, তারা এই বিষয়টি নিয়ে কমিটিতেও আলাপ করেছেন৷ পরিস্থিতি যে ভয়াবহ তাতে কোনো সন্দেহ নাই৷ তবে তিনি মনে করেন, ‘‘এখানে পুলিশ সব কিছু করতে পারবে না৷ পরিবার ও সমাজকে দায়িত্ব নিতে হবে৷ আর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোরও দায়িত্ব আছে৷ প্রত্যেক থানায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের একজন করে কারেকশন অফিসার আছেন তারাও দায়িত্ব পালন করেন না৷’’
পুলিশের আইজিপি বেনজীর আহমেদ গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের নিচে বয়স হলে শিশু বিবেচনা করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন৷ নূর মোহাম্মদও মনে করেন, মানসিক বয়সও বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন৷ কারণ পুরোপুরি পরিকল্পনা করে ফৌজদারী অপরাধ করার সক্ষমতা যার আছে তার সাধারণ বয়স ১৮-এর নিচে হলেও মানসিক বয়স বেশি৷
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার চার কোটি শিশু-কিশোর৷ এরমধ্যে এক কোটি ৩০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন মনে করেন, ‘‘ওই শিশুরা তো অপরাধে জড়িয়ে পড়তেই পারে৷’’
অধ্যাপক কার্জনের মতে, নিম্নবিত্ত পরিবারে যেমন বাবা -মা দুইজনই কাজে বেরিয়ে যান, তেমনি মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারেও বাবা-মা সন্তানকে সময় দেন না৷ তারা নানা ধরনের গেম, সিনেমা দেখে, একাকিত্বের কারণে অপরাধী হয়ে ওঠে৷ আর সমাজ ও রাষ্ট্রে অপরাধ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারও তাদের অপরাধে প্রলুব্ধ করে৷
রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার শিশুদের জন্য শিশুবান্ধব পরিবেশ দিকে ব্যর্থ হচ্ছে৷ তাদের মধ্যে মূল্যবোধ তৈরি করতে পারছে না৷ যার পরিণতি আমরা এখন দেখছি বলে তিনি মনে করেন৷
তবে পরিবারের নজরদারি ও মূল্যবোধ এই কিশোর অপরাধ অনেক কমিয়ে আনতে পারেন বলে মনে করেন তিনি৷