বিশেষ প্রতিবেদক॥
কয়েক বছর ধরে আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় দেশজুড়েই এলপিজি ব্যবহার বেড়েছে। গত ৪ বছরে দেশে এলপিজি সিলিন্ডারের ব্যবহার ৫ গুণ বেড়েছে। আর চাহিদা বাড়ায় বাজার জাতকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। ফলে যেখানে সেখানে অবৈধভাবে মজুদ করে ওই ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার বেচাকেনা বেড়েছে। বেশিরভাগ দোকানি বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্স ছাড়াই এলপিজির ব্যবসা করছে।
বর্তমানে পাড়া-মহল্লার মুদি দোকানেও এলপি সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছে। ওসব দোকানির অনেকেরই গ্যাস সিলিন্ডার কেনাবেচার অনুমোদন তো দূরের কথা, ট্রেড লাইসেন্সই ও নেই। ওসব দোকানে নেই আগুন নির্বাপক যন্ত্র। বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে প্রতিকারেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। ঘনবসতিপূর্ণ বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোারণের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। বাড়ছে প্রাণহানির ঘটনা
ও। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী গত বছরে বিস্ফোরক পদার্থে যেসব দুর্ঘটনার তদন্ত হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডারে দুর্ঘটনা।
এমন পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে অবৈধভাবে এলপিজি গ্যাস বিক্রি রোধে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (ডিএনসিআরপি) অভিযান চালাবে। ডিএনসিআরপি এবং বিস্ফোরক পরিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে বিগত ৪ বছরে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি পাঁচগুণ বেড়েছে। গত অর্থবছরে দেশে আমদানি করা ৩৯ লাখ ৬৪ হাজার ৭২৮টি এবং দেশে তৈরি ১১ লাখ ৪ হাজার ৩৪৫টি এলপিজি সিলিন্ডার বাজারাজাত করা হয়েছে। আর এলপি গ্যাস সিলিন্ডার বেচাকেনা হয়েছে ৫০ লাখের বেশি। তার আগের অর্থবছরে ওই বিক্রির পরিমাণ ছিল ৫২ লাখ ৮৯ হাজার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২১ লাখ ৮৫ হাজার এলপি গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হয়।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল মাত্র ১০ লাখ সিলিন্ডার। বর্তমানে লাখ লাখ সিলিন্ডার বিক্রি হলেও সারাদেশে এলপিজি সিলিন্ডার মজুদের জন্য সব মিলিয়ে মাত্র ৬ হাজার লাইসেন্স নিয়েছে। তার মধ্যে অনেকেই আবার লাইসেন্স নবায়ন করেনি। বেশিরভাগই লাইসেন্স ছাড়া বিক্রি করছে। আবার ৪০টি মজুদের লাইসেন্স নিলেও শত শত মজুদ রেখে বিক্রি করছে। সম্প্রতি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (ডিএনসিআরপি) টাঙ্গাইল জেলায় অভিযান চালায়।
সংস্থাটির অভিযানে ৯৫ শতাংশ দোকানে বিম্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্স ছাড়া এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রির প্রমাণ পাওয়া যায়। ফলে সংস্থাটি অবৈধভাবে বিক্রির অপরাধে ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে।
সূত্র জানায়, এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার মজুদ ও বিক্রি করতে বিম্ফোরক লাইসেন্স নেয়া বাধ্যতামূলক। ছোট লাইসেন্সধারী কোনো দোকানি ৪০টির বেশি সিলিন্ডার মজুদ রেখে বিক্রি করতে পারে না। কিন্তু ৯৫ শতাংশ দোকানেই লাইসেন্স ছাড়া এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান আইন ভঙ্গ করে ২০০ থেকে ২৫০ সিলিন্ডার মজুদ রেখে বিক্রি করারও প্রমাণ মিলেছে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ ওই পণ্য সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না। বড় কোম্পানিগুলো লাইসেন্স নিয়েই এলপিজি সিলিন্ডার বাজারে ছাড়ছে।
কিন্তু বিক্রির ক্ষেত্রে ডিলারদের লাইসেন্স আছে কিনা কোম্পানিগুলো তা পরীক্ষা করে দেখছে না। দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ছোট দোকানের বেশিরভাগেরই বিস্ম্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্স নেই। পাশাপাশি তদারকির অভাবে ঝুঁকি জেনেও দোকানিরা সনদ ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছাড়াই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি অনেক খুচরা এলপি গ্যাস বিক্রেতা আইন না জেনেই ব্যবসাটি চালিয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ দোকানি ব্যবসা পরিচালনার সাধারণ ট্রেড লাইসেন্স নিলেও ১০টির বেশি সিলিন্ডার মজুদ রেখে বিক্রির ক্ষেত্রে বিম্ফোরক সনদ নেয়া বাধ্যতামূলক।
কিন্তু ওসব দোকানে ২০টি থেকে শতাধিক সিলিন্ডার মজুদ রেখে বিক্রি করলেও সনদ নেই। একেক দোকানে নানা ব্র্যান্ডের এলপি গ্যাসবোঝাই সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে। কোথাও কোথাও চা ও পানের দোকান ছাড়াও হার্ডওয়্যার, সিমেন্ট, মনোহরি ও মুদি সামগ্রী বিক্রির দোকানেও এলপি গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, দেশে সাধারণত উৎপাদনকারীর কারখানা থেকে ডিলাররা সিলিন্ডার ক্রয় করে।
তারপর ডিলাররা খুচরা ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সরাসরি ভোক্তাদের কাছে এলপি গ্যাসপূর্ণ সিলিন্ডার পৌঁছায়। সেক্ষেত্রে উৎপাদনকারীরা ডিলারদের কাছে সিলিন্ডার সরবরাহের ক্ষেত্রে বিম্ফোরক পরিদপ্তরের সনদের বিষয়টি যাচাই করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। যদিও বিস্টেম্ফারক আইন ১৮৮৪-এর অধীনে গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা-২০০৪-এর ৬৯ ধারা অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া অনধিক ১০টি গ্যাসপূর্ণ সিলিন্ডার মজুদ করা যাবে।
তবে বিধির ৭০ ধারা অনুযায়ী ওসব সিলিন্ডার মজুদ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জাম মজুদ রাখতে হবে। এলপিজি স্থাপনা প্রাঙ্গণে ধূমপান, দিয়াশলাই বা আগুন লাগতে পারে এমন কোনো বস্তু বা সরঞ্জাম রাখা যাবে না। মজুদ করা স্থানের কাছে আলো বা তাপের উৎস থাকা চলবে না। কিন্তু ওসব আইনের তোয়াক্কা না করে চায়ের দোকানে চুলার পাশে মজুদ রেখে কিংবা সিগারেটের দোকানে বিক্রি হচ্ছে এলপিজি সিলিন্ডার।
এদিকে এলপিজি বিক্রি বাড়াতে কোম্পানিগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে যত্রতত্র ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে। যদিও তাদের লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাছাড়া এলপিজির মতো দাহ্য পদার্থ মজুদের জন্য বিশেষ গুদামঘর থাকতে হবে। তা না হলে সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বের হয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
গত বছরে বিম্ফোরক পদার্থে যেসব দুর্ঘটনার তদন্ত হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডারে দুর্ঘটনা। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রামের চন্দনাইশের বদুরপাড়ায় বিভিন্ন কোম্পানির ৩৩ থেকে ৩৫ কেজির বড় এলপি গ্যাসপূর্ণ সিলিন্ডার থেকে ১২ কেজির সিলিন্ডারে এলপি গ্যাস রিফিল করার সময়ে সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বের হয়ে ভবনের পেছনে কক্ষে ছড়িয়ে পড়ে। ওই গ্যাস ভরার কাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের একজন সিগারেট জ্বালানোর উদ্দেশ্যে দিয়াশলাইর কাঠি জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিবিম্ফোরণের সৃষ্টি হয়।
এতে ভবনের সম্পূর্ণ অংশ বিধ্বস্ত হয় এবং ৪ জন কর্মচারী গুরুতর অগ্নিদগ্ধ হন। আরেক তদন্তে, গত জানুয়ারিতে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার চৌমুহনী বাজারে একইভাবে বড় সিলিন্ডার থেকে ছোট সিলিন্ডারে গ্যাস রিফিল বা ভর্তি করার সময় রুমের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কক্ষে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা না থাকায় আগুনে ভবনের তিনটি রুম বিধ্বস্ত হয় এবং কর্মচারী গুরুতর অগ্নিদগ্ধ হয়। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় জামালপুর প্রত্যন্ত অঞ্চলে এফএস কসমেটিকস কোম্পানির কারখানায় শর্টসার্কিটের কারণে আগুন ধরে এলপিজি সিলিন্ডার বিম্ফোরণ হয়।
তাতে এক নারী শ্রমিক ঘটনাস্থলে মারা যান। আরো ১০ শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হন। তাছাড়া গত জুনে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একটি বাজারে গ্যাস সিলিন্ডার বিম্ফোরণে ৬টি দোকান ভস্মীভূত হয়েছে। তাতে প্রায় ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। গত সেপ্টেম্বরের রাজধানীর কাফরুলে মনা মিয়ার চায়ের দোকানে ধূমপান শেষে সিগারেটের অংশ ছুড়ে ফেলায় আগুনের ফুলকি গ্যাস সিলিন্ডারে পড়ে বিম্ফোরণ হয়। তাতে চারজন দগ্ধ হয়। গত ৪ অক্টোবর পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা পরিষদে আয়োজিত উন্নয়ন মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে গ্যাসের সিলিন্ডার বিম্ফোরণে শিশু শিক্ষার্থীসহ ৬ জন আহত হয়েছে। গত ১৬ অক্টোবর কক্সবাজারের টেকনাফের জাদিমুরা শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গ্যাস সিলিন্ডার বিসেম্ফারণে শিশুসহ একই পরিবারের ৩ জন দগ্ধ হয়েছে।
এভাবে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। তারপরেও সংশ্লিষ্টদের টনক নড়ছে না। তাছাড়া এলপিজি সিলিন্ডারে গ্যাস ভরা ও সিলিন্ডার পরীক্ষার দায়িত্ব কোম্পানিগুলো। কিন্তু সেগুলো নিয়মিত পরীক্ষা না করায় ত্রুটি থেকে যাচ্ছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বিম্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিম্ফোরক পরিদর্শক মো. সামসুল আলম জানান, খুচরা দোকানে ১০টি সিলিন্ডার বিক্রি করতে পারবে। আর তার বেশি বিক্রি করতে হলে প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলকভাবে বিম্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্স নিতে হবে। সনদ ছাড়া ব্যবসা সম্পূর্ণ বেআইনি। বর্তমানে এলপিজি গ্যাস বিক্রির ক্ষেত্রে সারাদেশে ৬ হাজার সনদ আছে। সনদ না নিয়ে এলপিজি বিক্রি করলে বিষয়টি আইন অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসন দেখার কথা। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ কর্মকর্তারা এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
বিম্ফোরক পরিদপ্তরের জনবল কম থাকায় এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা না থাকায় ব্যবস্থা নিতে পারছে না। তবে ডিএনসিআরপি অভিযান পরিচালনা করলে তাদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করবে বিম্ফোরক পরিদপ্তর।
একই প্রসঙ্গে ডিএনসিআরপির মহাপরিচালক শফিকুল ইসলাম লস্কর জানান, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ৫২ ধারা অনুযায়ী সেবা গ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে এমন কোনো কাজ করলে ৩ বছরের কারাদ-বা অনধিক ২লাখ টাকা অর্থদ-বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ এ জ্বালানি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করে পরিদপ্তরের লাইসেন্স ছাড়া অবৈধভাবে যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে।
এ কারণে শিগগিরই সারাদেশে অবৈধভাবে এই জ্বালানি বিক্রি বন্ধে অভিযান চালানো হবে। ইতিমধ্যে জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বাজার তদারকি করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।