প্রতিষ্ঠান হিসেবে র্যাব এবং এর সাত সাবেক ও বর্তমান প্রভাবশালী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিদ্যমান মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শিথিলে যুক্তরাষ্ট্রে যেসব প্রসেস বা প্রক্রিয়া রয়েছে তা যথাযথভাবে অনুসরণের তাগিদ দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্থনি জে ব্লিনকেন।
কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তির দিনে ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে নিষেধাজ্ঞা পুনর্বিবেচনার অনুরোধের জবাবে ব্লিনকেন এ তাগিদ দেন। ওই বৈঠকে মোমেন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়ের জন্য ব্লিনকেনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন বলে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।
সোমবার স্থানীয় সময় দুপুরে (বাংলাদেশ সময় মধ্যরাত) অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে হোটেলে ফিরে মন্ত্রী মোমেন তার সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। মন্ত্রীর সফরসঙ্গী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা ওই ভিডিও ব্রিফিংটি গণমাধ্যমে শেয়ার করেন। সেখানে মন্ত্রী বলেন, ব্লিনকেনের সঙ্গে বৈঠকে আমি বাংলাদেশের এলিট সিকিউরিটি ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এর উজ্জ্বল ভুমিকা এবং বাড়াবাড়ি করা সদস্যদের বিচারের বিষয়টি তুলে ধরে নিষেধাজ্ঞা পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেছিলাম। জবাবে তিনি প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে বলেছেন।
গত চার মাসে বাংলাদেশে কোনো বিচারবহির্ভুত হত্যা না হওয়ার বিষয়ে ব্লিনকেন অবহিত জানিয়ে মন্ত্রী মোমেন বলেন, আমি তাকে এ-ও বলেছি যে গত চার মাসে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অধীনে একটি মামলাও হয়নি।
মন্ত্রী বলেন, মার্কিন মন্ত্রী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, অবশ্যই তাদের অ্যাকাউন্টিবিলিটি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের মধ্যে যারা অপরাধে অভিযুক্ত তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। মন্ত্রী বলেন, তাদের বিচারে দেশে যে ম্যাকানিজম রয়েছে, সে সম্পর্কে জানিয়েছি। তাদের ১২ জন বা তার বেশি সদস্যের মৃত্যুদণ্ড হওয়ার বিষয়েও বলেছি। নিষেধাজ্ঞা এবং অন্যন্য ইস্যুতে ভাল আলোচনা হয়েছে দাবি করে মন্ত্রী মোমেন বলেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে সময় লাগবে, ওই কমিটিতে যারা আছেন তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে হবে পরবর্তী রেমেডিয়াল মেজারস দিয়ে। নিষেধাজ্ঞা কোনো সুইস বোর্ড নয় যে চাপলেই এটা অন বা অফ হয়ে যাবে- এমন মন্তব্যও করেন মন্ত্রী মোমেন।
সূচনা বক্তব্যে যা বলেছেন ব্লিনকেন ও মোমেন
এদিকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের সূচনায় যুক্তরাষ্ট্রের ৬ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতা (হোস্ট) পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্থনি জে ব্লিনকেন এবং পরে অতিথি ৭ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. মোমেন বক্তব্য রাখেন। সূচনা বক্তব্যে ব্লিনকেন বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনকে এখানে পেয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে অংশীদারিত্ব আরও জোরদারে একসঙ্গে কাজ করতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আমরা আজ কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন করছি। আমরা ফেলে আসা দিনগুলোকে স্মরণ করে আজ পরবর্তী ৫০ বছরের দিকে তাকাচ্ছি। ভবিষ্যতেও আমরা একসঙ্গে কাজ করবো এবং আমাদের অংশীদারিত্বকে আরও শক্তিশালী করতে পারবো বলে আশা রাখি। ব্লিনকেন বলেন, পৃথিবী আজ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কঠিন সংকটের মুখোমুখি, এটি মোকাবেলায় অন্যান্য দেশকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিচ্ছে।
আমরা এটি গভীরভাবে উপলব্ধি করি। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র একত্রে কাজ করছে উল্লেখ করে মার্কিন মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র কোভ্যাক্সের মাধ্যমে ৬ কোটি ভ্যাকসিন দিতে পেরেছে, এ জন্য আমরা গর্বিত। মিয়ানমারে নিপিড়নের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা প্রায় ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়াসহ তাদের ভরণ-পোষণে বাংলাদেশ অসাধারণ মানবতা ও উদারতা দেখাচ্ছে উল্লেখ করে ব্লিনকেন বলেন, এ জন্য আমরা বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞ। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ অন্যতম শক্তিশালী সমর্থক হিসেবে কাজ করছে এবং অন্য অনেক কিছুর জন্যও বাংলাদেশ আজ প্রশংসিত। এশিয়া অঞ্চল তথা বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র নানা বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, ভবিষ্যতেও উভয়ের মধ্যে এই সদ্ভাব ও আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় এবং কাজ পাওয়ায় ব্লিনকেনের প্রতি কৃতজ্ঞতা মোমেনের
সূচনা বক্তব্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেনের উদ্দেশ্যে মন্ত্রী মোমেন বলেন, আমাকে সময় দেয়া এবং সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে বৈঠকের সুযোগ দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। একই সঙ্গে আমি আপনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, আমাদের ৬১ মিলিয়ন টিকা দেয়ার জন্য। একক দেশ হিসবেই যুক্তরাষ্ট্রই আমাদের সবচেয়ে বেশি টিকা দিয়েছে। আপনাদের এই অনুদানের কারণেই ভ্যাকসিন গ্রহণে বাংলাদেশ আজ শীর্ষস্থানে পৌঁছেছে। তাছাড়া সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের প্রায় ৩১ মিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছে, এসবের জন্যও ধন্যবাদ। মন্ত্রী বলেন, আমি আরেকটি কারণে আপনাকে ধন্যবাদ জানতে চাই যে, আপনারা মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ওপর চালানো বর্মী গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়েছেন, এ কাজে আপনার অবদানে আমরা অত্যন্ত খুশি। আশা করি নির্যাতিতরা এতে কিছুটা হলেও প্রশান্তি পাবে এবং বাস্তুচ্যুতের প্রত্যাবাসনের পথ সুগম হবে।
মন্ত্রী মোমেন বলেন, আমি খুব খুশি যে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পক্ষ থেকে আমরা একটি দুর্দান্ত চিঠি পেয়েছি।আগামীর দিকনির্দেশনা রয়েছে এতে। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অসাধারণ অনেক অর্জন রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আমাদের অনেক খারাপ সময় গেছে, ভাল সময়ও গেছে। ভাল-মন্দ সব সময় আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বন্ধু হিসেবে পাশে পেয়েছি। এখন আমরা আমাদের সম্পর্কের আরও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য উন্মুখ হয়ে আছি। সে কারণেই আজ আমি এখানে এসেছি। মন্ত্রী মোমেন বলেন, আমি এটাও বলতে চাই যে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ সত্যিই অনেক অগ্রগতি সাধন করেছে, আমাদের অর্জন অনেক।
আমরা তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত ছিলাম কিন্তু আজ বাংলাদেশ একটি প্রাণবন্ত অর্থনীতি এবং বিপুল সম্ভাবনার দেশে পরিণত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের এই উত্তরণে মহান অংশীদার। বছরের পর বছর ধরে আপনারা আমাদের সমর্থন যুগিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার এবং বড় বিনিয়োগকারী আখ্যা দিয়ে মন্ত্রী মোমেন বলেন, বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ জ্বালানি খাতে। কিন্তু আমি মনে করি এখন আমাদের জ্বালানির বাইরে তাকানোর সময় এসেছে।
অন্যন্য সম্ভাবনায় খাতে মার্কিন বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমরা আরও উন্নত অর্থাৎ রক-সলিড রিলেশন গড়তে চাই, আমি ব্যক্তিগতভাবেও সেই দিনের অপেক্ষায়। জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় যুক্তরাষ্ট্রে কাটানোর সুযোগের জন্য মার্কিন নেতৃেত্বের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে মোমেন বলেন, আমি সবসময় আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। কারণ আমি যখন গৃহহীন, বেকার এবং রাষ্ট্রহীন ছিলাম, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই আমাকে একটি বাড়ি ও চাকরি দিয়েছে। এ জন্য আমি (ব্যক্তিগতভাবে) যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞ।