সোনাই নিউজ: হবিগঞ্জ জেলার ২০ লক্ষাধিক মানুষের নির্ভশীলতার প্রতীক ‘হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতাল’। যে কোন শ্রেণির রোগীরা প্রথমেই এর উপর নির্ভশীল হন। অথচ ‘হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতাল’ নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, রোগীর শয্যা, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও প্রয়োজনীয় উপকরণ সংকটের বিষয়টি এখন চরম আকার ধারণ করেছে। এছাড়া হাসপাতালে অবিবেচক মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ, মাদকসেবী ও দালালদের দৌড়াত্ব লাগামহীন।
জানা যায়, একরখম ‘জোড়া-তালি’ দিয়েই চলছে আধুনিক হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম! সরেজমিনে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে গিয়ে লক্ষ্য করা যায়, কয়েকজন রোগী শুয়ে আছেন ভাঙ্গা সিটে। সিটগুলো এতই অকেজো যে, দাঁড় করানো হয়েছে ‘ইটের পায়ে’। মহিলা মেডিসিন ও সার্জারী ওয়ার্ডে ‘বাঁশের টুকরো’ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ‘স্যালাইন স্ট্যান্ড’। পুরো হাসপাতাল জুড়েই রয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট। হাসপাতালের অভ্যন্তরে স্থাপিত নলকূপটি তুলে নেয়া হয়েছে অজ্ঞাত কারণে। সৌন্দর্য্য বর্ধনের জন্য স্থাপিত পানির ফোয়ারাটি বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন যাবত। ভাঙ্গা-ছোড়া বিভিন্ন ওয়ার্ডের টয়লেটের দরজা। এতে করে বিপাক-বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে মহিলা রোগীদের। শয্যা সংকট থাকায় বহু রোগীকে দিনের পর দিন থাকতে হচ্ছে মেঝেতে। দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালের ড্রেনগুলোতে পড়ে আছে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ। যে কারণে দূর্গন্ধ এখন নিত্যদিনের সঙ্গী।
অভিযোগ রয়েছে, একটি দালাল সিন্ডিকেটের কারণে হাসপাতালে প্রায়ই দেখা দেয় রক্ত সংকট। এতে প্রতারনা, হয়রানী ও ভুগান্তির শিকার হন রোগীরা। চিরাচরিত নিয়মে ঔষধের সংকট তো লেগেই আছে।
নামে ২৫০ শয্যার হলেও বাস্তবে এ সংখ্যা মাত্র দুইশ’র কিছু বেশী। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, প্যাথলজিষ্ট ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংকটও প্রকট। বিষেশ করে এখানে দীর্ঘদিন ধরে শূণ্য রয়েছে মেডিসিন, কার্ডিওলজিস্ট ও গাইনী বিভাগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পদ।
ভূক্তভোগীদের অভিযোগ, নার্সদের দূর্ব্যবহারে অতিষ্ট রোগী ও স্বজনরা। যে কারণে প্রায়ই ঘটে বাক-বিতন্ডার ঘটনা। শুধু তাই নয়, হাসপাতাল থেকে সরবরাহকৃত খাবার খুবই নিম্নমানের বলে অভিযোগ করেছেন বহু রোগীর। তারা জানান, অনেক সময় ডাক্তারের দেয়া ‘পথ্য’ অনুযায়ী খাবার সরবরাহ না করায় বিপাকে পড়তে হয় তাদের।
দৈনিক হাজিরায় ভাড়াটে বহিরাগতদের দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করানোর মত অভিযোগ রয়েছে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে। হাসপাতালের কতিপয় কর্মচারী মাঝে-মাঝেই বিনা ছুটিতে থাকছেন অনুপস্থিত। এ ক্ষেত্রে তারা চিহ্নিত কিছু বহিরাগত ভাড়াটে ব্যাক্তিদের দৈনিক হাজিরায় কাজ করিয়ে থাকেন। এমন স্পর্শকাতর ও ভয়াবহ কাজটিতে না-কি মৌন সমতি রয়েছে পদস্থ কর্মকর্তাদের।
ভোক্তভূগিদের অভিযোগ, হাসপাতালে মাদকসেবী-ব্যবসায়ী, দালাল ও অবিবেচক মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের উৎপাতের বিষয়টি এখন চরম আকার ধারন করেছে। সন্ধার পর-পরই হাসপাতাল প্রাঙ্গণে বসে মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের মিলন মেলা। অনেক সময় এদের উৎপাতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় রোগী ও স্বজনদের। যে কারণে মাঝে মাঝে ঘটে ছিনতাইয়ের ঘটনা।
শুধু তাই নয়, দালালদের দৌড়াত্ব যেন দিন-দিন বেড়েই চলেছে। রোগীকে প্রাইভেট হাসপাতালে ভাগিয়ে নিতে টানা-হেচড়ার ঘটনা যেন নিত্যদিনের চিত্র। এ কাজে দালালদের সহযোগিতা করে থাকেন খোদ কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই। এ ছাড়া বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির অবিবেচক মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের উৎপাতে খোদ চিকিৎসকরাই এখন বিব্রত। কাক ডাকা ভোর থেকেই হাসপাতাল প্রাঙ্গণে শুরু হয় তাদের উপচে পড়া ভীড়। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে রোগীদের সাথে তাদের অশ্লীল কাড়া-কাড়ির দৃশ্যটি নূন্যতম শিষ্টাচারকেও হার মানায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, হাসপাতালটিতে দীর্ঘদিন ধরে চলছে অবৈধ সার্টিফিকেট বাণিজ্য। জনৈক কর্মচারীর সমন্নয়ে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ সার্টিফিকেট বাণিজ্যের প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। ভুয়া সার্টিফিকেট (এম.সি) সরবরাহ করে এরা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এ নিয়ে ইতিপূর্বে স্থানীয় পত্রিকায় একাধিক সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’ হলেও রহস্যজনক কারণে নিরব ভুমিকা পালন করছেন কর্তাব্যক্তিরা। এতে করে একদিকে যেমন আইনী মোকাবেলায় হয়রানী ও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন নিরপরাধ মানুষ। অপরদিকে সুবিধা নিচ্ছে অপরাধীরা।
এ বিষয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. রতিন্দ্র চন্দ্র দেব ডাক্তার ও শয্যা সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘চলতি মাস থেকে ২৫০ শয্যার কার্যক্রম শুরু হলেও কিছু সংকট রয়েই গেছে। দিনে-দিনে বেড়েই চলেছে ডাক্তার সংকট। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বার-বার লিখিতভাবে জানানো হলেও এর সুরাহা হচ্ছে না। উপজেলা থেকে ডাক্তার এনে সংকট দূরীকরণের চেষ্টা করা হচ্ছে।’
তাছাড়া, নতুন যন্ত্রপাতি না আসার কারণে পুরনোগুলো দিয়ে করতে হচ্ছে। তাই এ অবস্থার সৃষ্ট হয়েছে।
মাদকসেবী ও দালালদের উৎপাতের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দালালদের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়েছে। প্রয়োজনে আবারও হবে। আমরা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আর মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের বিষয়ে তাদের সংগঠন ‘ফারিয়া’কে (ফার্মাসিউটিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ এসোসিয়েশন) বিষয়টি লিখিত ভাবে জানানো হয়েছে। আশা করি অচিরেই এর সমাধান হবে’।