নিজস্ব প্রতিবেদক ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮,
আজ থেকে আপিল শুনানি, যেভাবে নিষ্পত্তি হবে ৫৪৩ আবেদন –
রিটার্নিং অফিসাররা যাদের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন তারা তাদের প্রার্থিতা ফিরে পেতে নির্বাচন কমিশনে আপিল করেছেন। গত তিন দিনে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ মোট ৫৪৩ জন নির্বাচন কমিশনে আপিল করেছেন। এর মধ্যে বৈধ ঘোষিত প্রার্থীর বিরুদ্ধেও আপিল করেছেন তার প্রতিপক্ষ। আজ থেকে এসব আপিলের শুনানি শুরু হবে বলে গতকাল ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জানিয়েছেন। এ দিকে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে বলে জানিয়েছেন দলটির যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। দলের নেতাকর্মীদের অব্যাহত গ্রেফতারের বিষয়ে গতকাল নির্বাচন কমিশন সচিবের কাছে দলীয় মহাসচিব স্বাক্ষরিত তিনটি চিঠি দেয়ার পর তিনি সাংবাদিকদের কাছে এ কথা বলেন।
গত ২ ডিসেম্বর রিটার্নিং অফিসাররা মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে বৈধ-অবৈধ ঘোষিত প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করেন। এরপর অবৈধ ঘোষিত প্রার্থীরা তাদের প্রার্থিতা ফিরে পেতে ইসিতে আপিল করা শুরু করেন। গতকাল বুধবার ছিল আপিলের শেষ দিন। শেষদিনে ২২২টি আপিল জমা পড়ে। এর আগে সোমবার ৮৪ জন ও মঙ্গলবার ২৩৭ জন আপিল করেন। বেশির ভাগ আপিলই মনোনয়নপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে।
ইসি সচিব বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ কমিশন আজ থেকে টানা তিন দিন আপিলের শুনানি করে সাথে সাথে সংুব্ধদের ফল জানিয়ে দেয়া হবে। আপিলের প্রথম দিনে ১ থেকে ১৬০, দ্বিতীয় দিনে ১৬১ থেকে ৩১০ এবং শেষ দিন ৩১১ থেকে ৫৪৩ ক্রমিক পর্যন্ত শুনানি হবে বলে জানান সচিব। তিনি বলেন, ইসির সিদ্ধান্তে কেউ ুব্ধ হলে উচ্চ আদালতে যেতে পারবেন। আপিল গ্রহণের শেষ দিনে গতকাল ইসি সচিব সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
গতকাল শেষদিনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পে তিনটি আসনে প্রার্থিতা ফিরে পেতে পৃথক আপিল করা হয়েছে। বর্তমানে কারাবন্দী খালেদা জিয়ার পে ফেনী-১ এবং বগুড়া-৬ ও-৭ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া হয়। দু’বছরের বেশি সাজা হওয়ার কারণে তার সব মনোনয়নপত্র বাতিল করেন রিটার্নিং অফিসাররা।
প্রসঙ্গত, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের ও স্বতন্ত্রসহ ৩ হাজার ৬৫ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। এগুলো যাচাইয়ের পরে ৭৮৬ জনের প্রার্থিতা বাতিল করেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। ফলে বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ২৭৯ জনে।
মতাসীন দল আওয়ামী লীগের ২৬৪টি আসনে ২৮১ জন প্রার্থীর মধ্যে নৌকার বৈধ প্রার্থী ২৭৮ জন, বাতিল ৩ জন। বিএনপির ২৯৫টি আসনে ধানের শীষে ৬৯৬ জন প্রার্থীর মধ্যে বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা ৫৫৫ জন, বাতিল হয়েছে ১৪১ জন। জাতীয় পার্টি ২১০ আসনে ২৩৩ জন প্রার্থীর মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে বৈধ প্রার্থী ১৯৫ জন, বাতিল হয়েছে ৩৮ জন।
উল্লেখ্য, নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ২৮ নভেম্বর মনোনয়নপত্র দাখিল ও ২ ডিসেম্বর বাছাই। ৯ ডিসেম্বর প্রত্যাহার এবং ৩০ ডিসেম্বর ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
মুক্ত খালেদাকে নিয়েই নির্বাচনে যাবে বিএনপি : বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে বলে জানিয়েছেন দলের যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। তিনি বলেন, হয়রানি ও গ্রেফতার বাণিজ্য এখনো চলছে। বাম্পার ফলন যেভাবে হয়, সেভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প থেকেও গ্রেফতারের বাম্পার ফলন শুরু করা হয়েছে। মঙ্গলবারও একজন নারী কমিশনারসহ কয়েকজন প্রার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মঙ্গলবার কোম্পানীগঞ্জে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সাহেবের গাড়িতে সশস্ত্র হামলা করা হয়েছে। সেটিও অবহিত করেছি এবং এ গ্রেফতার বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে দ্রুত এবং জরুরি পদপে গ্রহণ করার জন্য বলেছি।
বেগম খালেদা জিয়ার প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে আপনি কতটা আশাবাদী জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সর্বশেষ সময় পর্যন্ত আশাবাদী যে, মুক্ত বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়েই আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব। যাদের প্রার্থিতা প্রাথমিক পর্যায়ে রিটার্নিং কর্মকর্তারা বাতিল করেছেন সেগুলোর আপিলের শুনানি ৮ ডিসেম্বর শেষ হবে। আমরা বলেছি এটা ৮ তারিখ পর্যন্ত না নিয়ে ৬ এবং ৭ তারিখের মধ্যে সম্পন্ন করা যায় কি না। অথবা নির্বাচন কমিশনের নিজেদের বিবেচনাপ্রসূত কোনো পদ্ধতিতে অতিদ্রুত সম্পন্ন করলে তা প্রার্থীদের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
আলাল বলেন, বিএনপি মহাসচিব স্বাক্ষরিত তিনটি চিঠি বুধবার কমিশনে পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক সংলাপে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানি বন্ধে প্রধানমন্ত্রী আশ^াস দিয়েছিলেন। ইসির সাথে সংলাপেও এ আশ^াস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মাঠের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানি অব্যাহত রয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করে বিএনপির ওই চিঠিতে বলা হয়, নির্বাচনী মাঠে সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য এবং ভয়ভীতিহীন পরিবেশে নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে নেতাকর্মী-সমর্থকদের গায়েবি অজুহাতে অন্যায় আটক, গ্রেফতার ও হয়রানি বন্ধে জোর দাবি জানাচ্ছি।
বিএনপির তিন চিঠিতে যা বলা হয়েছে
আপিল দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি : গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এর অনুচ্ছেদ ১৪ (৫) এর অধীনে রিটার্নিং অফিসারদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল দায়েরের সময়সীমা বুধবার শেষ হয়েছে। আপিল নিষ্পত্তির জন্য শুনানি ৬ হতে ৮ ডিসেম্বর ধার্য করা হয়েছে। ঘোষিত তফসিল মোতাবেক প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ৯ ডিসেম্বর।
বিএনপির চিঠিতে বলা হয়, আপিল নিষ্পত্তির বিলম্বের জন্য ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে দলের প্রার্থিতা চূড়ান্তকরণে জটিলতা সৃষ্টি হবে। প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে কষ্টসাধ্য হবে। এমতাবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের স্বার্থে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থিতা চূড়ান্তকরণের সুবিধার্থে ৬ ও ৭ ডিসেম্বরের মধ্যেই কিংবা অতি দ্রুততার সাথে আপিল নিষ্পত্তির অনুরোধ করেছে বিএনপি।
প্রতীক বরাদ্দ ও চূড়ান্ত মনোনয়ন : প্রতীক বরাদ্দ ও চূড়ান্ত মনোনয়ন নিয়ে ইসির কাছে কিছু বিষয় স্পষ্ট করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। আরপিওর ১৬ (২) অনুচ্ছেদ অনুসারে একটি আসনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের দুই বা ততোধিক বৈধ প্রার্থী থাকলে একজনকে চূড়ান্ত মনোনয়ন প্রদানের জন্য কোনো নিদিষ্ট ফরম আছে কি-না এবং ফরম না থাকলে দলের প্যাডে পত্র আকারে প্রদান বৈধ বা গ্রহণযোগ্য হবে কি না সে বিষয়টি জানতে চেয়েছে দলটি। আরপিওর ২০ (১) অনুচ্ছেদের শর্তাংশে বর্ণিত মতে, দুই বা ততোধিক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের একক প্রতীক বরাদ্দের চিঠির কোনো নির্দিষ্ট ছক আছে কি না? না থাকলে প্রতীক বরাদ্দের পত্র কমিশনে নাকি সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারের কাছে দিতে হবে সে বিষয়টিও জানতে চেয়েছে বিএনপি।
কোনো কোনো আসনে দুই বা ততোধিক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের একাধিক বৈধ প্রার্থী রয়েছেন। দলগুলো যৌথভাবে একক প্রার্থী ও প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য যথাসময়ে কমিশনে পত্র দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আরপিওর ২০ (১) অনুচ্ছেদের বিধান মতে যেকোনো একজন বৈধ প্রার্থীকে প্রতীক বরাদ্দের পত্র দিলে জোটভুক্ত অন্য দলগুলোর বৈধ প্রার্থীর প্রার্থিতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হবে কি না অথবা জোটভুক্ত দলগুলোর যেকোনো একজন বৈধ প্রার্থীকে জোটের প্রধান দল হিসেবে বিএনপির পক্ষ থেকে ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দ দেয়ার পর জোটভুক্ত অন্যান্য দলের বৈধ প্রার্থীকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে হবে কি না তা জানতে চাওয়া হয়েছে