সাভারে হঠাৎ করেই বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড। শুরুর দিকে রাস্তার পাশে একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া, বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে পার্টি করা ও মেয়েদের ইভটিজিং করার মতো অপরাধে যুক্ত থাকলেও এখন তাদের অপরাধের মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত ৯ মাসে সাভারে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয়েছেন দশম শ্রেণির ৩ জন শিক্ষার্থী। নিহতরা হচ্ছেন, রোহান, নিলা রায় ও জয় হালদার। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সাভারের বিভিন্ন এলাকায় এদেরকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে।
কিশোর গ্যাংয়ের হত্যাকাণ্ডের তিন ঘটনা: গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর রাতে বাড়ি ফেরার পথে স্কুলছাত্রী নীলা রায়কে তার ভাইয়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে কিশোর গ্যাং সদস্য মিজানুর ছুরিকাঘাতে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। মূলত প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে হত্যা করা হয়েছিল। চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রেমঘটিত দ্বন্দ্বের কারণে দশম শ্রেণির ছাত্র রোহানকে প্রকাশে কুপিয়ে হত্যা করে অপর একটি কিশোর গ্যাং। এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় প্রায় ৩০ সদস্যের একটি বাহিনী।
সর্বশেষ গত ১৬ মে সাভারের রাজাশন এলাকার পুলুর মার্কেটের সামনে জয় হালদার নামে এক ছাত্রকে কুপিয়ে আহত করে কিশোর গ্যাং। প্রায় ২০ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ৬ জুন জয় হালদার মৃত্যু হয়। উল্লেখ্য, নিহত তিনজনই দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয়দের কয়েকজন জানান, সাভার পৌর এলাকার ৯টি ওয়ার্ডের প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই একাধিক কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। শুরুতে বিচ্ছিন্নভাবে এরা আড্ডা অথবা দল বেঁধে ছোটখাটো অপরাধ করলেও, পরে এদেরকে প্রকাশ্যে মদদ দিতে থাকে এলাকার স্থানীয় প্রভাবশালীরা। আর এখন প্রতিটি ওয়ার্ডেই কিশোর গ্যাং তৈরি করে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে মাদক ও চাঁদাবাজির ব্যবসা।
কেবল মাত্র ৩নং ওয়ার্ডেই রয়েছে ৫টি কিশোর গ্যাং। আর এদের নিয়ন্ত্রণ করছেন কাউন্সিলর সানজিদা শারমিন মুক্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী বলেন, সানজিদা শারমিন মুক্তা ৩নং ওয়ার্ডে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি গড়ে তুলেছেন বিশাল মাদকের সিন্ডিকেট। নাজিম ও হিন্দাম নামের দুটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে এসব সিন্ডিকেট। এই গ্যাংয়ের সদস্যরা মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো এলাকা। অনেকে জানান, মূলত এদের সক্রিয় অবস্থানের কারণেই এলাকার কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় না।
কাউন্সিলর মুক্তার নিয়ন্ত্রণে থাকা আরও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা হচ্ছে, শান্ত, মানিক, পাখি, গ্যাস মুন্না ও নয়ন বাহিনী। মূলত এদের মাধ্যমে ছায়াবীথি, সবুজবাগ, সোটাইটি, বনপুকুর, সোবহানবাগ ও বালুরমাঠ এলাকায় মাদকের সিন্ডিকেট পরিচালনা করা হচ্ছে। ফোন কল করলেই মাদক পৌঁছে যাচ্ছে গ্রাহকের হাতে। ডিজিটাল এমন সেবা কার্যক্রম একার পক্ষে চালানো সম্ভব না, তাই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছেন কাউন্সিলর সানজিদা শারমিন মুক্তা। নাম প্রকাশ না করা শর্তে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন ৩নং ওয়ার্ডের এক ইট বালু ব্যবসায়ী। তিনি আরও জানান, এলাকায় বাড়ি করতে হলে ইট, বালু, সিমেন্টের কাজ দিতে হবে আর বাড়ি বিক্রি করতে দিতে হবে কমিশন, এমন অলিখিত নিয়ম চালু করেছেন একজন মহিলা কাউন্সিলর। এ ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করা হলে কাউন্সিলর সানজিদা শারমিন মুক্তা বলেন, আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা রটনা করা হচ্ছে, এসব অভিযোগ মিথ্যা।
কিশোর গ্যাংয়ের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে সাভার উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম রাজিব যুগান্তরকে বলেন, আইন শৃঙ্খলা সভায় সাভার উপজেলার বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিদের কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়ে অবগত করা হয়েছে এবং কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করা হচ্ছে। কাউন্সিলর সানজিদা শারমিন মুক্তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ৫টি কিশোর গ্যাং বাহিনী, বিষয়টি অবগত করা হলে মঞ্জুরুল আলম রাজিব বলেন, এমনটি হয়ে থাকলে বিষয়টি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা সভার আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জানতে চাইলে সাভার মডেল থানার ওসি কাজী মাইনুল ইসলাম বলেন প্রতিবেদককে বলেন, আমি দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে ৮-১০ জনকে গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করেছি। কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে এবং এই অভিযান অব্যাহত থাকবে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, কিশোর গ্যাংকে যেই মদদ দিক না কেন, তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। কিশোর গ্যাংয়ের হাতে ঘটে যাওয়া আরও কিছু ঘটনা: কিশোর গ্যাংয়ের হাতে নির্যাতনের শিকার হলেও অনেককেই ভয়ে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ কিংবা কথা বলতেও সাহস পান না। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে সাভারের পৌর এলাকার মধ্যপাড়া মহল্লায় ছুরিকাঘাত করে সুমন রাজবংশী ও শিমুল রাজবংশী নামে দুই যুবককে গুরুতর আহত করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর পরিবার মামলা দায়ের করলে পুলিশ আল-আমিন, পারভেজ ও রহিম নামে তিন কিশোরকে গ্রেফতার করে। চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে পৌর এলাকার থানা রোডে এনাম মেডিকেল হাসপাতালের সামনে এক তরুণীকে যৌন হয়রানি করে এক দল কিশোর। এর প্রতিবাদ করলে সৌরভ ও আলিফ নামে দুই যুবককে মারধর করে আহত করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। গত বছরের ৩০ আগস্ট বিকালে দুই কিশোরী আশুলিয়ার গুলিয়ারচক এলাকায় বেড়াতে যায়। সেখানে ১০ থেকে ১২ জনের একটি কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা দুই কিশোরীকে নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। এর দুই ঘণ্টা পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। পরে ওই দুই কিশোরীকে ধর্ষণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হলে লোকলজ্জার ভয়ে ওই কিশোরী ও তার পরিবার গ্রামের বাড়ি চলে যায়।