কাঙ্গাল মাহাম পাগলার উক্তি দিয়েই শুরু করছি- ”নাই আমার ঘর আর বাড়ী তবুও আমি আশা করি, বাবার উরশ যেন করতে পারি। কি হবে মোর ধন সম্পদে আজ মরলে কাল দুইদিন হবে,তাই সবাই মোরে কইরেন দোয়া, আমি করতে পারি যেন এই মানুষ সেবা।” দীর্ঘদিন ধরে দেখছি মানিকগঞ্জ পৌরসভাধীন পশ্চিম দাশরার একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে একজন পাগল থাকেন। ঝাকড়া ও জটাচুলের বাধনে লালপোশাক পরিহিত মানুষটি কখনো একা খালি পায়ে হাটেন আবার কখনো তার জীবন সঙ্গীনিকে সাথে নিয়ে মানবসেবার গাড়ি চালান। চা,পান,চটপটি,ফুসকাসহ হরেক জিনিস নিয়ে হকার শ্রমিক হয়েও সেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়েজিত রাখেন। তাকে জানতে ইচ্ছে হলো গভিরভাবে তাই দফায় দফায় আসি পাগলের কাছে।
জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যমতে পাগলের নাম মাহাম বেপারী (৬২)। পিতা মৃত আলেফ বেপারী,মাতা আমিরজান বেগম ও স্ত্রী আছিয়া বেগম। পিতামহের নিবাস ছিলো ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার বারুয়াখালী গ্রামে।নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে তার পিতা বাড়ি করেন মানিকগঞ্জ জেলাধীন সিংগাইর উপজেলার জামশা ইউনিয়নের জামশা ধলেশ^রী নদীর তীরে। গ্রামীণ যৌথ প্রান্তিক ও ক্ষেতমজুরভিত্তিক পরিবারে বেড়ে ওঠা মাহাম পাগলার জীবনে রয়েছে অনেক সংগ্রামের অধ্যায়।
ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন বাউন্ডেলে ¯^ভাবের তাইমানুষের পছন্দ অপছন্দের ভিরে পরিবার ও সমাজে বাস করার আগ্রহ কমতে থাকে।গান বাজনা ও বিভিন্ন যাত্রার দলে ঘুরে বেরাতেন বলে বাড়ির কেউ তার খোজ রাখতো না। প্রাতিষ্ঠাডিনক স্কুলের প্রতি তার আগ্রহ ছিলো কম তবে পীর মুরশিদের স্কুলের প্রতি ঝোক ছিলো বেশি। ছোটবেলায় বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত হয়ে তিনি চরমভাবে আহত হন এবং তার হৃদয়ে দাগ কাটে যে আমরা কোথায় ছিলাম কোথায় এলাম কোথায় যাব। এই ভাবনায় তিনি নিজের ভিতর পরম ইশ^রের খোজে তথা মওলার খোজে অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদের চেতনা নিয়ে আশেকান পীর মুরশিদের দরবার ও মাজার শরিফে ঘুরে বেরান দেশ বিদেশের প্রান্ত থেকে প্রান্তে।
মওলার পাগল হয়ে কাঙ্গাল মাহাম পাগলার জীবনের একটি বড় অধ্যায় কাটে ঢাকার মীরপুরে হযরত বাবা শাহ আলীর দরবার শরিফে। তারপর বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বাগেরহাট জেলার প্রতাপশালী আউলিয়া হযরত বাবা শাহ খানজাহান আলীর মাজার শরিফে এসে হযরত বাবা নূর মুহাম্মদ চিশতির নিকট তিনি দিক্ষা গ্রহন করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই গুরু তার প্রতি খুশি হয়ে খেলাফত প্রদান করেন এবং বিয়ে করে সংসার করার মন্ত্রনা দিয়ে দেন। মাহাম পাগল রাজি না হলেও তার গুরু তাকে বলেন সংসার সাগর পারি না দিয়ে মওলাকে পাওয়া যাবে না। সংসার মায়াজাল থেকে তাকে সিদ্ধ করেই পরধামের জন্য মুক্তি নিতে হবে।এই মন্ত্রনা নিয়ে তিনি তরিকার ভাইদের সহযোগীতা নিয়ে মহাদেবপুর গ্রামের আছিয়া বেগমকে বিয়ে করেন। বিয়ের পরই জীবন সারথীকে সাথে নিয়ে শুরু হয় জীবন সংগ্রামের নতুন অধ্যায়।তরিকার ভাই সালাম পাগলাসহ আশেকানদের টানে ছুটে আসেন মানিকগঞ্জ শহরে। তরিকার ভাইদের বাড়িতে কিছুদিন আশ্রয় নিয়ে কাজ শুরু করেন পথে পথে হকারি। আরিচা ফেরি ঘাটে দীর্ঘদিন চলে তার এই জীবন সংগ্রাম। আরিচা ঘাট পাটুরিয়া যাওয়াতে তিনি চরমভাবে আহত হন এবং ফেরিঘাটের হকারি বাদ দিয়ে ক্ষোভে দু:খে নতুন কিছু করার ¯^প্ন নিয়ে একেবারেই মানিকগঞ্জ শহরে চলে আসেন।
তারপর বিভিন্ন বাসায় ভাড়া থেকে এখন মোটামুটি স্থির আছেন পশ্চিম দাশরার চার রাস্তার মোরে সুলতান মিয়ার বাড়িতে।পরিত্যক্ত এই বাড়িতে থাকলেও বাসাভাড়া,গ্যাস,পানি,বিদ্যুতসহ তাকে স্থয়িী খরচা হিসেবে গুনতে হয় প্রতি মাসে তিন থেকে সারে তিন হাজার টাকা। পোশাক চিকিৎসা খাওয়াসহ কম হলেও আরো দরকার নয় থেকে দশ হাজার টাকা। মোট কথা প্রতিদিন তার অন্তত পাচশত টাকা রোজগার দরকার হলেও ¯^ামী স্ত্রী মিলে পুরি,ছোলা,পিয়াজও বানিয়ে দুইশত থেকে আরাইশত টাকার বেশি রোজগার করতে পারে না। তারপর ঝড়বাদল তো আছেই প্রতিদিন কাজ সম্ভব নয়। বৈশি^ক মহামারী করোনাকালের কঠিন জীবন সংগ্রামের মধ্যেও পাগল না খেয়ে হলেও ঘরভাড়া নিয়মিত দিতেন। কিন্তু বর্তমানে মহামারী করোনাকালসহ নানাবিধ প্রতিকুলতা কাটিয়ে উঠতে না পারায় তিনিও ঋণের দুষ্টচক্রে পরতে বাধ্য হয়েছেন।পাগল মাহাম বলেন একদল বকধার্মিক আমার পাকপবিত্রতা নিয়ে গোপনে কুৎসা রটায় এবং অন্যেরা যাতে আমার হাতের পুরি না খায় সেই কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেফলে বেচাবিক্রি একটু কম হয়। তারপরও সাম্প্রদায়িক এই পশুত্বের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই তবে বিলাপ করি যে সমাজ এখন গজগজা সাম্প্রদায়িকতায় ভরপুর। মানুষ মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়–ক আর না পড়–ক ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িতে ব্যাস্ত। নিজের খবর না করে কে অযু ও নামাজ কিভাবে পড়লো,পাক না নাপাক ও আস্তিক না নাস্তিক এই নিয়ে কাইজা ঝগড়ায় ব্যাস্ত। সমাজের সকল স্তরে এই দৃশ্য দেখে আমি আরো মর্মাহত।
পাগল আরো বলেন-রাত জেগে গান গাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে পারি নাই। কাজের ফাকে রাতে গান করলে আবার দিনে কাজ করা মুশকিল হয়। আয় রোজগার যা হয় সেগুলো নিয়ে আবার ছুটে যাই বাবার মাজারসহ বিভিন্ন দরবার শরিফে। ভারতের আজমির শরিফে হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতি (র.) দরবার শরিফে একাধিকবার ভ্রমন করার অবিজ্ঞতায় আমি ধন্য হয়েছি।
ইতেমধ্যে আমার জীবনের বেলা শেষে সংসার বড় হয়। অসময়েই মেয়েদের পরের বাড়িতে বিয়ে দিয়ে এবং ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ না করতে পারার বেদনা আমাকে আরো আহত করে। তারপরও আমার প্রতি স্ত্রী, দুই কণ্যা ও পুত্র তারা খুশি থাকলে আমি মহাখুশি। তারপরও সংসারের সবাইকেরেখে বিভিন্ন দরবারে ঘুরলেও আমার স্ত্রী আছিয়া বেগমের কোন অভিযোগ নেই। শুধু তাই নয় আমার অনুপস্থিতিতে আমার প্রাণপ্রিয় সহধর্মিনী পশ্চিম দাশরা মোরে চিতই পিঠা,ছোলা ও পুরি বিক্রি করে সংসার সামাল দেন। সংসারে ছেলেমেয়েরা বড় হলে তাদের প্রয়োজন বারতে থাকে তাই পাগল মাথায় হাত দেয় এবং চিন্তা করে যে সংসারের বাসনা মনে চিলো না বলেই সঞ্চয় করিনি এবং এটি আমার দ্বারা হবেও না। আমি মানুষের দেওয়া ভালোবাসা ও টাকা পয়সা যা পেয়েছি তার সবই যে ঘাট দিয়ে এসেছে সেই ঘাটেই ব্যয় করেছি। তাতে আমার দোষ কি মুরশিদ ভরসা।পাগল বলেন সংসার সমারঙ্গনের শেষ বেলায় এসে স্ত্রী পুত্র ও ছেলে মেয়েদের তাগিদে একখন্ড ভূমি,নিজ¯^ আবাস বা ঠিকান খুবই দরকার বলে মনে করছি। আমি এখন দিন রাত মেহানত করে বেরাচ্ছি এই ঠিকানা তৈরীর জন্য।
সমস্যা হলো ধনবাদী পূজিবাদী এই সমাজ ব্যাবস্থায় মানুষের জীবন যাত্রায় ব্যায় কয়েকগুণ বেরে যাওয়ায় এবং আবাসভূমি সম্বলিত মাটির দাম ¯^র্ণের মত হওয়াতে এবং ক্ষুদ্র আয়ে জীবন চালিয়ে আমার জীবদ্দশায় সম্ভবত এটি করা সম্ভব নয়। এটি ভেবেই মুক্তিযুদ্ধের ¯^পক্ষের ক্ষমতাসীন সরকার এর গত টার্মেই আমি মানিকগঞ্জ পৌরসভার মাধ্যমে ডিসি অফিস ও ভূমি অফিসে ভূমিহীনদের নামে খাসজমি বন্দবস্তের ফরমে আবেদন করি। আমার কাছে কয়েক দফায় তদন্ত্রে আসে এবং কর্তাব্যাক্তিরা আমার ছবি তুলে নিয়ে যান। তারা আশাšি^ত করেন যে ২০২১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্মশতবার্ষিকীতে সরকার কাউকে গৃহহীন রাখবে না বলে ভূমিহীনদের জন্য খাস জমি ঘরসহ ররাদ্দের ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। শুনে খুবই খুশি হলাম য়ে এবার মনে হয় একটি ঠিকানা হবে। আমি প্রায় দিনই ভূমি অফিসে খোজ খবর রাখি কিন্তু কর্তাব্যক্তিরা আমাকে বলে বালিরটেক বা দূরে দিলে তো আপনি থাকতে পারবেনা না দেখি শহরেই রাখতে পারি কিনা। এই বলে শান্তনা দিলেও চুরান্ত তালিকায় আমার নাম খুজে পেলাম না। খুবই হতামশ হলাম, আমার কথা হলো আমার চেয়ে দরিদ্র যদি কেউ থাকে সে পেলে আমার আনন্দ লাগবে কিন্তু বিপরীত হলে কষ্ট লাগে। আমার মতন যারা বঞ্চিত হয়েছেন তারা বলে আবার আবেদন করতে হবে আমি আর আবেদন করতে না চাইলেও তাদের অনুরোধে আবার পৌরসভা থেকে ভূমিহীন সনদ নিয়ে খাস জমি বন্দেবস্তের জন্য আবেদন করলাম।
এখন আমি এতটুক বুঝতে পারলাম যে আমার মত দেশে যারা সুবিধাবঞ্চিত ভূমিহীন সর্বহারা,ক্ষেতমজুর,হকার তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার অধিকার আদায়ের জন্য। আমার প্রাপ্য হক ও ন্যায্য অধিকার থেকে আমাদেরকে যারা বঞ্চিত করলো তাদের বিরুদ্ধে একা কথা বলার শক্তি আমার নেই তবে একটি ভূমিহীন সমিতি থাকলে আমি তাদের সদস্য হয়ে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সামিল হইতাম। যাহোক আমি সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে চাই। সমাজের এই অভেদ পাহার সমান বৈষম্যের অবসান ঘটাতেই দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়। বঙ্গবন্ধু একটি সামাজিক ন্যায্যতার সমাজ গঠন করতে চেয়েছিলেন ¯^াধীনতা বিরোধীরা সেটি করতে দেয়নি। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের প্রধান দাবিদার হলেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে এটি কাম্য নয়। তারপরও আমরা বিশশ^াস করি দারিদ্র্য বিমোচন হ্রাসসহ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনিকে শক্তিশালী করতে সরকার বদ্ধপরিকর। কোন ভূমিহীন রাস্তারয় থাকবে না। ১৯৭২ সালের সংবিধান মতে খাস জমি ভূমিহীনদের দখলে থাকবে। অচিরেই মাহাম পাগলদের ন্যায্য হিস্যার দাবি সরকার ঘরসহ খাস জায়গা বুঝিয়ে দিবে এই প্রত্যাশা করি।